বঙ্গবন্ধুর ডাকে দোকানের ঝাপের লাঠি হাতে মিছিলে অংশ নিয়েছিল ১৩ বছর বয়সী শঙ্কু সমাজদার। রংপুরে একাত্তরের ৩ মার্চ অবাঙালীদের গুলিতে প্রাণ হারায় এই কিশোর।
দেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ শঙ্কু। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি গেজেটে ক্যাটাগরিগত সমস্যার কারণে শঙ্কুর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে শহীদ হওয়ার পরও বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি জোটেনি তার কপালে।
শঙ্কুর সঙ্গে মিছিলে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন বলেন, দেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ শঙ্কু। ওই সময় রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল সে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শঙ্কু যদি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পায় তাহলে তা আমাদের দোষ, আমাদের অবহেলা। সেই প্রথম শহীদ।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ চান শঙ্কুর মিছিলে থাকা এই বীরযোদ্ধা।
তিনি বলেন, ‘৩ মার্চ আমাদের মিছিলটি যখন রেলস্টেশন হয়ে শহরের দিকে আসতেছিলো, তখন উর্দুতে লেখা একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে আমাদের। বর্তমান ঘোড়াপীর মাজারের সামনে অবাঙালি সরফরাজ খানের বাসায় (বর্তমান আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়) উর্দুতে লেখা ওই বোর্ড নামাতে যায় মিছিলে থাকা শংকু সমাজদার, শরিফুল আলমসহ কয়েকজন। তখনই সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে গুলি চালালে শঙ্কু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।’
তিনি জানান, শঙ্কুকে গুলি চালানো হয়েছে এবং সে মারা গেছে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে গোটা রংপুরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কমিশনার মুসলিমউদ্দিন শঙ্কুকে কোলে নিয়ে একটি মিছিল বের করেন। এই মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে মানুষ ক্ষেপে যায় এবং শহরে পাকিস্তানি বিহারিদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতে বলেছিলেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে আমার ভায়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ’। তিনি কার জন্য বলেছিলেন এই কথা? শহীদ শঙ্কুর প্রসঙ্গেই বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন রংপুরকে নিয়ে।”
‘আমরা কী বলবো? অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছেন, হয়েছেন। অথচ ক্যাটাগরির দোয়াই দিয়ে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না দেয়াটা লজ্জাজনক।’
রংপুর জেলা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু নিউজবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবে ২০১২ সালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছিল রংপুরের শঙ্কু সমাজদার। পরে ক্যাটগরির মধ্যে পড়ে না বলে তার নাম প্রত্যাহার করা হয়।
এ নিয়ে ক্ষোভে আর দুঃখ আছে শঙ্কু সমাজদারের মা দীপালি সমাজদারের।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাবা (শঙ্কু ) খুব ভালো আছিল, ওইদিন সকালে মুই বাবাক নাস্তা দিয়ে কং, বাইরে যাসনে বাবা, খুব গ্যামজ্যাম চলোছে। মোর কতা শুনিল নে, একটা মিছিল বের হইচে এই কতা শুনিয়া বাড়ি থেকে দৌড় দিয়ে বাহির হয়া যায়া পাশের একটা দোকানের ঝাপের নাটি নিয়ে মিছিলোত যায়। একনা পর শুনি মোর বাবা নাই। বাবা, মুই শেখের বেটির ( প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার) সাথে দেকা করবেন চাং, মুই আর কয়দিন বাঁচিম? মোর বেটাক যেন ওমরা মুক্তিযোদ্ধা বানায়।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, শঙ্কুর মাকে ৩ মার্চ নগদ ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও তার মা জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ির সীমানা প্রাচীরটা যেন করে দেয়া হয়। আমরা খুব দ্রুত সেটা করে দেব। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন তার নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন বলেও জানান ডিসি।
এর আগে ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে সরকারি নির্দেশে ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় রংপুর জেলা প্রশাসন নগরীর কামাল কাছনা এলাকায় তার পৈত্রিক ভিটাসংলগ্ন বেদখল হয়ে যাওয়া ১০ শতক জমি উদ্ধার করে জমির দলিলপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।