বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘যতক্ষণ জ্ঞান থাকত, ততক্ষণ পেটাত’

  •    
  • ২৬ মার্চ, ২০২১ ২২:৪৪

সেই টর্চার সেলে এক দুই দিন নয়, টানা ১৯ দিন পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা এম জি কবির বুলু ও আনোয়ার হোসেনকে।

একাত্তরের ১৬ জুলাই সকাল। একটি স্টেনগান, ম্যাগাজিন, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ নৌকায় করে আগৈলঝাড়া থেকে এম জি কবির বুলু ও সহযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন যাত্রা শুরু করেন চর কমিশনারের উদ্দেশে। সঙ্গে ছিলেন নৌকার মাঝি মেহের আলী।

পথে গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর খালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তারা। ওই দিনই তাদের নেয়া হয় গৌরনদী কলেজের সেনাক্যাম্পে। সেখান থেকে বাটাজোর সেনাক্যাম্প ও পরে বরিশাল নগরীর ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে।

সেই টর্চার সেলে এক দুই দিন নয়, টানা ১৯ দিন পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা এম জি কবির বুলু ও আনোয়ার হোসেনকে।

এম জি কবির বুলু জানান, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে করা হতো নির্যাতন। পাক বাহিনীর কথা না শুনলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যেত কয়েকগুন।

যতক্ষণ জ্ঞান থাকত, ততক্ষণ পেটানো হতো। জ্ঞান হারানোর ভান করে থাকতেন বুলু। নির্যাতনের এক পর্যায়ে সইতে না পেরে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আত্মহত্যা পাপ ভেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তরুণ ওই মুক্তিযোদ্ধা।

তবুও মুখ খোলেননি বুলু। যন্ত্রণায় ছটফট করলেও মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে সহ্য করেন নির্যাতন। টানা ১৯ দিন টর্চার সেলে নির্যাতনের পর পাঠানো হয় কারাগারে, সেখানে তিন মাস সইতে হয় আরও নির্যাতন।

মুক্তিযোদ্ধা এম জি কবির বুলু বলেন, ‘থানায় নিয়ে আমার হাত ওরা পেছন থেকে বেঁধে দিল। আমি চার কালেমা পড়ে নিই। তারপর কিছুক্ষণ পেটায় তারা। গ্রেনেড ও স্টেনগান উদ্ধার হয়েছে, এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা তুলে নিয়ে যায় গৌরনদী কলেজে।

“নিচ তলাতে জেরা চলে, বলে, ‘ঘাবড়াও মাত, তোমকো ছোড় দুঙ্গা, সব সাফ সাফ বাতাও।’ মনে মনে বললাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমার জবান নিয়া যাও। জবান থেকে যেন কোনো কথা না বেরোয়।”

বুলু বলেন, ‘দোতলায় নিয়ে এক ক্যাপ্টেন মুখে ও পেটে ঘুষি দিতে থাকে। কলেজের পশ্চিম পাশের রুমে আমাদের পা দুটি বেঁধে পায়ের পাতায় পেটাতে শুরু করে। পা ফুলে গেলে তাতে ওরা বেয়নেট দিয়ে খোঁচা দেয়। পিনপিন করে পা দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।

‘পরে ৩০ জন মিলে ৩ জনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিটাতে থাকে। শুরু করে আবারও জেরা। গালি দিয়ে বলে, সাফ সাফ বাতাও। এ মেজর জলিল কাহা, মঞ্জু কাহা, মুক্তি কাহা, সাফ সাফ বাতাও।’

‘আমি বলি, ‘কুছ নেহি জানতা।’

একাত্তরে পাক হানাদারের কাছে স্টেনগান, ম্যাগাজিন ও গ্রেনেড নিয়ে ধরা পড়ার পর যেসব নির্যাতন সইতে হয়েছিল তা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবির বুলু

‘এক দফা মারে। আবার জিগায়। বেয়নেট দিয়া হাতে পায়ে পোঁচ দেয় আর বলে, ‘বাতাও’। ওরা বাম কানে একটা বাড়ি দিতেই কানের পর্দা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। সারা জীবনের জন্য বাম কান বন্ধ হয়ে যায়।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আনোয়ারকে দেখে বলে, ‘তুম আর্মি হ্যায়, কমান্ডার হো।’ ওকে বাঁচাতে আমি চেঁচিয়ে বলি, ‘নেহি, ও আনসার হ্যায়। মাই কমান্ডার হ্যায়। ইয়ে স্টেনগান, ম্যাগাজিন, গ্রেনেড সব হামারা হ্যায়।’

“তুম কমান্ডার?’ শুরু হয় আরও টর্চার। ঘাড়ে একটা বাড়ি দেয়, চোখে কিছুই দেখি না। যন্ত্রণায় ছটফট করছি। চিৎকার করে কাঁদছি। ওই যন্ত্রণার কথা কীভাবে বুঝাব”, বলেন বুলু।

‘ওদের বলি, আমাকে একটা গুলি দাও। দুপুরের দিকে আমার নিথর দেহ দেয়ালে ঠেকিয়ে পিস্তল গলার কাছে ধরল এক মেজর। আমি তার চোখের দিকে চোখ রাখি। কিন্তু গুলি করল না।’

‘বেয়নেট দিয়ে গলায় একটা পোঁচ দিল মাত্র। টর্চারের যন্ত্রণা সইতে পারতাম না। কিন্তু তবুও মুখ খুলিনি। কতবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তাও পারিনি।’

বুলু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন জনকে এক রশিতে বেঁধে ওরা আমাদের একটা আর্মি ভ্যানে তুলে নেয়। বডিতে তখন ছোপ ছোপ রক্ত। একটু ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে পড়তেই জ্বালা করছিল। ওরা বলল, তোদের মেরে কুকুরকে খাওয়াব। আমাদের আনল বরিশাল ওয়াপদা ক্যান্টনমেন্টে। এক কর্নেল বলে, ঠিক হ্যায়, উস কো ভেজ দো।’

তিানি জানান, ১৫ জন আসামিকে ওরা একটা রুমে রাখল। তখনও কান দিয়ে ফোটা ফোটা রক্ত পড়ছে। স্টেটমেন্ট নিতে এক মেজর আসে কাঁচা লাঠি হাতে। পেটাল ঘণ্টাখানেক। শরীর তখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

বুলু নির্যাতনের কথা স্মরণ করে কাঁপছিলেন কথাগুলো বলার সময়। বলেন, ‘১৮ জুলাই ভোরে টর্চারে আনোয়ার মারা গেল। বুকের ভেতরটা তখন হু হু করে ওঠে। আহা রে, ওর মুখটা কীভাবে ভুলব! আনোয়ারের দুই হাত পা ধইরা ওরা ওয়াপদার খালে নিয়া ফালায়া দেয়।’

‘বরিশাল ক্যান্টনমেন্টে ১৯ দিন টর্চারের পর আমাকে প্রথম রাজেন্দ্র কলেজে এক রাত, এক‌টি সুগার মিলে এক রাত রেখে যশোর ক্যান্টনমেন্ট এবং পরে পাঠিয়ে দেয় সেন্ট্রাল জেলে। সেখানেও বেত মারত আর বলত, শালা, তোমকো খানা ইন্ডিয়া দিয়েগি।’

‘তখন চোখে দেখি না। কানে পুঁজ হয়ে গেছে। একেক রাতে তিন থেকে চারবার উঠিয়ে নিয়ে যেত। প্রতি বারই মনে হত আজই মেরে ফেলবে।’

এমজি কবির বুলু বরলেন, ‘২১ অক্টোবর পহেলা রমজানের দিন এক কয়েদি এসে বলল, রিলিজ। বিশ্বাস হয়নি। তার তিন মাস পর মুক্তি মেলে, মাঝি মেহেরকেও কিছুদিন পর ছেড়ে দেয়া হয়।’

মায়ের দোয়াতেই বেঁচে ছিলেন জানিয়ে বুলু বলেন, ‘ফিরে ঘরে যাইনি। আবার যাই যুদ্ধে। মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে আবারও যুদ্ধে অংশ নিই।’

৯নং সেক্টরের এই মুক্তিযোদ্ধা আরও জানান, একাত্তরের মে মাসে ক্যাম্প ছিল স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানা স্কুল। তারা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ওই ক্যাম্পে ছিলেন। সেখানে বাউকাঠি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পর দিন পাকিস্তানি সেনারা তাদের ক্যাম্প ঘেরাও করে। তারা অস্ত্র নিয়ে যে যার মতো পালিয়ে যান।

সেখান থেকেই বুলু এলএমজি নিয়ে চলে যান আগৈলঝাড়ায় গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে অস্ত্রটা মাটিচাপা দিয়ে ফিরে যান সদর উপজেলার চরকমিশনার এলাকার করিম হাওলাদারের বাড়ি। সেখানে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা মিলে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। বাড়িতে গিয়ে মাটির নিচ থেকে এলএমজিটা নিয়ে নৌকায় করে চরকমিশনারে যেতে ধরা পড়েন তারা।

এ বিভাগের আরো খবর