চাঁদপুরে নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা মানছেন না জেলেরা। প্রকাশ্যেই নির্বিচারে নিধন করছে ইলিশের পোনা জাটকা। দিনে ও রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে জাটকা নিধনের মহোৎসব।
মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু অসাধু জেলে জাটকা নিধনে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলেরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে জাটকা ধরা হলে মৌসুমে নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে না।
জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম শতভাগ সফল করতে জেলেসহ সকল স্তরের মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন জেলা প্রশাসন।
সদর উপজেলার হরিনা ফেরিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জাটকা শিকারে দলবদ্ধভাবে নৌকা নিয়ে নদীতে নেমেছে জেলেরা। নৌকার বহর দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে নদীতে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে তারা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জাটকা নিধনে মেতেছে জেলেরা।
বিশেষ করে চাঁদপুরের হরিনা, মোহনপুর ও পাশের মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল নিয়ে জাটকা শিকারে নদীতে নামছে। জাল ভর্তি হয়ে উঠে আসছে জাটকা মাছ।
জাতীয় সম্পদ জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার এলাকায় সরকার অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে।
নিষেধাজ্ঞার সময়ে জাটকাসহ সব ধরনের মাছ আহরণ, বেচা-কেনা, মজুদ ও পরিবহন নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারী ব্যক্তিকে মৎস্য আইনে ২ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও উভয় দণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে।
সদর উপজেলার হরিণা ফেরিঘাট এলাকার জেলে জামাল গাজী বলেন, ‘সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুই মাস। আমরা নিষেধাজ্ঞা মান্য করে নদীতে নামি না মাছ ধরতে। কিন্তু অনেক জেলেই নদীতে নেমে জাটকা মারছে। এভাবে জাটকা ধরা হলে আগামী মৌসুমে ইলিশ পাওয়া যাবে না। এতে করে আমরা যারা প্রকৃত জেলে রয়েছি তাদের কষ্টের সীমা থাকবে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরানবাজার রনগোয়াল ও বহরিয়া এলাকার বেশ কয়েকজন জেলের বক্তব্য হচ্ছে, সরকার যে পরিমাণ চাল দেয় তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। তা ছাড়া ৪০ কেজি করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে। আর শুধু চাল হলেইতো হয় না। ঋণের কিস্তি আছে, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা আছে, এসব খরচ মেটাতে অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের নদীতে নামতে হয় জাটকা ধরতে।
মেঘনা নদীতে নৌকা নিয়ে চলছে জাটকা ধরা
হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী এলাকার জেলে সিরাজ মিজি ও হারিস গাজী বলেন, ‘আমরা নদীতে না নামলেও বাইরে থেকে জেলেরা এসে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারা বাঁশ, চাকতি, লাঠি নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আসে। প্রতিদিনই তারা বিকেলের পর থেকে সারা রাত জাটকা ধরে। অর্থের বিনিময়ে প্রশাসনের কিছু কিছু সদস্যের সহযোগিতায় এই অসাধু জেলেরা জাটকা শিকার করে থাকে।’
হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুর হোসেন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমার এলাকার জেলেরা নদীতে জাটকা ধরতে নামে না। আমরা তাদেরকে নিষেধ করে দিয়েছি। কিন্তু আশপাশের বিভিন্ন এলাকার জেলেরা এখানে এসে জাটকা নিধন করছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আসে। এতে করে তাদেরকে প্রতিহত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। হাইমচর উপজেলায় জাটকা নিধন বন্ধে আমি প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।’
নৌ পুলিশের চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘নদীতীরে বসবাসরত জেলেরা যাতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকার না করে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আমরা যতক্ষণ নদীতে অবস্থান করি, ততক্ষণ জেলেরা নদীতে নামে না।’
নৌ পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমাদের সীমিত জনবল নিয়ে এতো বড় নদী পাহারা দেয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবুও আমরা রাত-দিন চেষ্টা করে যাচ্ছি। জাটকা নিধনের সঙ্গে আমাদের কোনো সদস্য জড়িত নেই। যদি কেউ এমন কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘জাটকা রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি তাদের এলাকার জেলেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তবেই এই কার্যক্রমের সফলতা পাওয়া আরো সহজ হবে।’
জেলা মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, ২৪ মার্চ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় মোট ২৪৬ বার অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে ১৪৭জন জেলেকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা, ৪৯ লাখ মিটার কারেন্ট জাল ও সাড়ে ১১ মেট্রিক টন জাটকা জব্দ করা হয়েছে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুল বাকী বলেন, ‘চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীতে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৫১ হাজার ১৯০ জন জেলে। এর মধ্যে এ বছর ৪০ হাজার ৫ জন জেলেকে জাটকা রক্ষাকল্পে ৪ মাস ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।
‘জাটকা রক্ষায় জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশের সদস্যরা পালাক্রমে নদীতে টহল দিয়ে যাচ্ছে। তবুও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক সময় অসাধু জেলেরা জাটকা শিকার করে থাকে। জেলেরা যাতে জাটকা রক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা তৎপর রয়েছি।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, চাঁদপুরে জাটকা রক্ষায় আমরা সবসময় কাজ করে যাচ্ছি। ২৪ ঘণ্টা নদীতে টহল দেয়া হচ্ছে। জাটকা রক্ষায় আমরা অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছি। এর সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।