বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আক্রমণ করলেও ভালুকের ওপর রাগ নেই পাহাড়িদের

  •    
  • ২৪ মার্চ, ২০২১ ১৭:৩৪

পাহাড়ে ভালুকের আক্রমণ খুবই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানের বাসিন্দারা এতে আর অবাক হয় না। ভালুকের প্রতি তাদের কোনো রাগও নেই।

কেউ যাচ্ছিলেন জুম চাষে, কেউ সংগ্রহ করছিলেন ঝিরিতে পেতে রাখা জাল থেকে মাছ। আবার কেউ ঝিরিতে গিয়েছিলেন পানি আনতে। বিভিন্ন সময় তারা শিকার হয়েছেন ভালুকের আক্রমণের। মারাত্মক আহত হয়েও প্রাণে বেঁচে গেছেন।

চলতি বছরে পাহাড়ে এ পর্যন্ত পাঁচজন ভালুকের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

প্রথম ঘটনা ঘটে বছরের একদম শুরুতে, ৩ জানুয়ারি। রুমার সানাইক্র পাড়ায় ঝিরিতে পানি আনতে গিয়েছিলেন ৪০ বছর বয়সী নারী ম্রা বওয়াং। হঠাৎ এক ভালুক এসে তাকে আক্রমণ করে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন।

প্রথমে স্থানীয় এক বৈদ্যের কাছে চিকিৎসা নেন ম্রা। কিন্তু কোমরের আঘাতে এক সময় পচন ধরলে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন।

এর পরের ঘটনা ঘটে থানচির বড়মোদকে। ২৭ জানুয়ারি পরিত্যক্ত জুমক্ষেত থেকে সবজি ও ফল সংগ্রহ করতে যাচ্ছিলেন সাবেক গ্রাম প্রধান ক্যাঅং প্রু। রাস্তায় একটি ভালুক এসে তাকে আক্রমণ করে।

জুম ক্ষেতে যাওয়ার সময়ই ২৬ ফেব্রুয়ারি বান্দরবান সদরের চিম্বুক ম্রো পাড়ায় ভালুকের আক্রমণের শিকার হন ইয়াংওয়াই ম্রো ও পাঁচ বছরের নাতনি মাংলিউ ম্রো।

এই ঘটনায় ইয়াংওয়াই ম্রো হারিয়েছেন একটি চোখ। প্রায়ই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং জ্ঞান ফেরার পর কিছু সময়ের জন্য স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। এখনও তিনি ইমানুয়েল মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইয়াংওয়াই ম্রো। ছবি: নিউজবাংলা

সবশেষ ঘটনা গত ১৪ মার্চের। আলীকদমের দুর্গম এলাকায় ঝিরিতে মাছ ধরার জন্য রাতে জাল পেতে রেখেছিলেন ক্রইলং ম্রো। সকালে সেই মাছ আনতে গিয়ে ছানাসহ একটি ভালুক এসে তাকে আক্রমণ করে।

পাহাড়ে ভালুকের আক্রমণ খুবই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আর এতে অবাক হয় না। কিন্তু ভালুকের প্রতি তাদের কোনো রাগও নেই। চেষ্টা করেন না ফাঁদ পেতে ভালুক মারার। কারণ ভালুকের এমন হিংস্রতার কারণ মনে করেন মানুষকেই। মানুষ ভালুকদের বাধ্য করেছে এমন হামলা চালাতে।

রুইসিং ম্রো নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ধরে নিন আমি কিছু সময়ের জন্য ভালুক হয়ে গেলাম। আপনি আমার স্বপ্নের ঘর ভাঙচুর করে দেন, আমার অভয়ারণ্য দখল করে নেন, আপনি আমার পরিবারকে এলোমেলো করে ফেলুন। এরপর বুঝবেন পৃথিবীতে আমার থেকে শ্রেষ্ঠ হিংস্র প্রাণী আর কেউ নেই।

‘ভালুকের সঙ্গে তো ঠিক এই কাজটিই করা হয়েছে। পাহাড়ের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল হারিয়ে যাচ্ছে। এই কারণে ভালুক দিন দিন হিংস্র প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে।’

ভালুকের আক্রমণের শিকার ইয়াংওয়াই ম্রো সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তাকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানান। তাদের এই ঋণ তিনি কোনোদিন শোধ করতে পারবেন না, কারণ সেদিন দ্রুত তাদের ভালো চিকিৎসা না দিলে হয়তো মারাই যেতেন।

ছোট্ট নাতনিসহ গুরুতর আহত হলেও ভালুকের ওপর কোনো ক্ষোভ নেই তার। ইয়াংওয়াই জানান, ভালুকের মানুষের মতো জ্ঞান থাকলে নিজেদের শত্রু চিহ্নিত করে প্রতিশোধ নিত। কিন্তু অবুঝ প্রাণী হওয়ায় যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই আক্রমণ করছে।

প্রবীণ সিংরাম জানান, তিন যুগ আগে বান্দরবানের থানচি, রুমা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি, লামা, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন অভয়ারণ্যে ভালুকদের বাস ছিল। তবে সে সময় ভালুকের এমন আক্রমণের কথা শোনা যায়নি।

তিনি বলেন, ‘ভালুক এখন আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করছে কেন? এসব বোঝার ক্ষমতা মানুষের থাকা আবশ্যক।’

প্রায় এক মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর বাড়ি ফিরেছে মালিউ ম্রো। কথা হয় তার বাবা, মা ও তার সঙ্গে। মালিউ ছোট্ট হলেও বড়দের মতো গুছিয়ে কথাগুলো বলে। সে বলে, ‘প্রথম প্রথম ভালুককে শত্রু ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আর ভাবছি না। ভালুক যদি আমার থাকার জায়গা নষ্ট করে দিত তাহলে আমিও এমনই করতাম।’

প্রায় এক মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর বাড়ি ফিরেছে মালিউ ম্রো। ছবি: নিউজবাংলা

তার বাবা-মা বলেন, পাহাড় তো মরুভূমি হতে চলেছে। বাকি যেটুকু বনাঞ্চল আছে তা সরকার ইচ্ছা করলে রক্ষা করতে পারে। নাহলে শুধু ভালুক নয়, আরও অনেক প্রাণী এ রকম আক্রমণ করবে আর মানুষকে পঙ্গু করে তার পরিবারের জন্য বোঝা বানিয়ে দেবে।

বান্দরবান বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ফরিদ মিঞা জানান, বান্দরবানে বর্তমানে ৯৯ হাজার ৩৩০ একর বনাঞ্চল আছে। তার মধ্যে ৮২ হাজার ৮০ একর ধরা হয়েছে সাঙ্গু রিজার্ভ।

তিনি বলেন, ‘বনবিভাগের সরকারি বনাঞ্চল সব ঠিকঠাক আছে, কোনো বনাঞ্চল উজাড় হয়নি। ভালুক মানুষদের আক্রমণ করেছে, এতে আমাদের কোনো দোষ নাই। আক্রমণের শিকাররা বনবিভাগ বরাবর চিঠি দিলে তাদের সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত বন্য ভালুকের আক্রমণের শিকার হয়ে কেউ সরকারি অনুদান নেননি।’

তবে কতজন এখন পর্যন্ত আক্রমণের শিকার হয়েছে সেই উত্তর নেই এই কর্মকর্তার কাছে।

ভালুকের আক্রমণে গুরুতর আহত হন বৃদ্ধ ক্রইলং ম্রো। ছবি: নিউজবাংলা

সরকারি ক্ষতিপূরণ কেন নেয়া হয়নি সে বিষয়ে ভুক্তভোগীরা জানান, পাঁচ/দশ হাজার টাকা দিয়ে কী হবে? এটি তো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তারা এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধান চান।

বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা নিউজবাংলাকে জানান, বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাসহ কিছু রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে যোগসাজশ করে সরকারি অভয়ারণ্য উজাড় করে দিয়েছে বন খেকোরা। এ কারণে ভালুকগুলো অভয়ারণ্য হারিয়ে লোকালয়ে চলে আসছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বন্যপ্রাণী গবেষক রায়হান সরকার নিউজবাংলাকে জানান, পাহাড়ের ভালুক জুমের পাকা ধান, পাহাড়ি আলু, কচু, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ডুমুর ফল খেতে পছন্দ করে। এ ছাড়াও জঙ্গলের বিভিন্ন লতাপাতা খায়। এদের বাসস্থান ও খাবারের উৎস ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এরা লোকালয়ে চলে আসছে এবং হিংস্র আচরণ করছে।

এ বিভাগের আরো খবর