‘মর্জিনা আর কুলসুম আমারে কয়, তাগো লগে যাইতাম, ইছতারি (ইফতারি) নিয়া দিব। (আদালতে) কুলসুম নাম ডাক দিলে আত তোলতাম (হাত তুলতাম)।’
আসামি না হয়েও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করা মিনু আক্তার এভাবেই বলছিলেন তার কারাগারে যাওয়ার গল্প।
ঘটনাটি চট্টগ্রামের।
হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আসামির বদলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই বছর নয় মাস ধরে জেল খাটছেন মিনু। এ ঘটনা জানাজানি হলে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ।
কারা কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মিনুকে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে নতুন করে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। সেই সঙ্গে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞা।
মামলার বিষয়ে শুনানি করা অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ এই তথ্য জানিয়েছেন।
আদালতে হাজির হয়ে তিন সন্তানের জননী মিনু মঙ্গলবার জবানবন্দিতে জানান, সময়টি ছিল ২০১৮ সালের রমজান মাস। ইফতারি দেয়ার কথা বলে কুলসুম ও মর্জিনা নামের দুইজন আদালতে মিনুকে নিয়ে যান। মিনুকে বলা হয়েছিল ‘কুলসুম’ নাম ডাকা হলে তিনি (মিনু) যেন হাত তোলেন। সে অনুযায়ী হাত তোলার পর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘কুলসুম’ হিসেবে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠায়।
মিনুকে এভাবে কৌশলে অপরাধী সাজানো কুলসুম একটি হত্যা মামলার আসামি। তার পুরো নাম কুলসুম আক্তার কুলসুমি।
২০০৬ সালের জুলাইয়ে নগরীর কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি আমগাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পারভীন নামের এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে, পারভীনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারের জন্য গাছে ঝুলিয়ে রাখেন কুলসুম। ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কুলসুমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এক বছর তিন মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
২০১৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন তখনকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক নুরুল ইসলাম। তাতে কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সে সময় কুলসুম পলাতক ছিলেন।
পরে আইনজীবী নাছির উদ্দীনের মাধ্যমে ২০১৮ সালের জুনে কুলসুম আত্মসমর্পণ করতে চান। আত্মসমর্পণের দিনই মিনুকে কুলসুম হিসেবে সাজিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। তখন থেকেই কারাগারে আছেন মিনু।
মিনুর ভাই মো. রুবেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ি সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর গ্রামে। ২০১৮ সালের রমজান মাসে খাদ্যসামগ্রী দেয়ার কথা বলে আমার বোন মিনুকে ডেকে নিয়ে যায় আমাদের পাশের বাড়ির মর্জিনা নামের একজন। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘আমার বোনের স্বামীর নাম মোহাম্মদ বাবুল। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তারাও জানত না তাদের মা কোথায় গেছে কিংবা কীভাবে গেছে। এক বছর আগে আমাদের এলাকার এক নারী পারিবারিক মামলায় জেলে গেলে আমার বোনকে সেখানে দেখে। উনি আমাদের ব্যাপারটি জানায়। কিন্তু আমরা যথাযথ প্রমাণ দিতে পারি নাই দেখে এত দিন তাকে বের করতে পারিনি।’
রুবেল জানান, মিনু মানসিক ভারসাম্যহীন। এই সুযোগে তাকে কুলসুমের বদলে আসামি বানিয়ে আদালতে নেন কুলসুমের আইনজীবী নাছির উদ্দীন।
রুবেল বলেন, ‘২০০৭ সালে যখন কুলসুম জেলে যায়, তখন মর্জিনার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে জেল থেকে বের হয়ে দুজন মিলে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করে। আর আমার বোন একটু মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় বিভিন্ন সময় রাস্তায় ঘুরত। সেই সুবাদে ওরা আমার বোন মিনুর ব্যাপারে জানতে পারে।
‘এভাবে ইফতার দেয়ার কথা বলে কুলসুম আর মর্জিনা মিলে আমার বোনকে আদালতে নিয়ে যায়। সে সময় কুলসুম নাম ডাকলে আমার বোনকে হাত তুলতে বলে তারা। কথামতো আমার বোন হাত তুললে তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বোনকে কৌশলে জেলে নেয়ার পেছনে কুলসুমের আইনজীবীর হাত আছে।’
মিনুর এই ঘটনা সম্প্রতি জানতে পারেন কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার আমি কারাগারের নারী ওয়ার্ডে পরিদর্শনে যাওয়ার পর মিনু আক্তার আমাকে বলেন তিনি আসল আসামি না। পরে তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করে তার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে পুরোনো রেজিস্টার চেক করে ঘটনার সত্যতা পাই।
‘কারণ মামলার মূল আসামি কুলসুম আক্তার ২০০৭ সালে একবার জেলে এসেছিলেন। সত্যতা পেয়ে আমরা জেলের পক্ষ থেকে আদালতে মিনুর বক্তব্যের সাপেক্ষে একটি আবেদন করি।’
অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ জানান, ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার মিনু আক্তারকে অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় আদালত তার বক্তব্য যাচাইয়ের জন্য সাজা পাওয়া আসামি কুলসুম আক্তারের ছবি-সংবলিত পুরোনো রেজিস্টার খাতা উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়।
এরপর মঙ্গলবার আবার মিনুকে আদালতে তোলা হলে বিচারক তার নথি হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দেন।