মাত্র ৯ বছর বয়সে কাজ শুরু করেন আব্দুর রশিদ। লেখাপড়ায় আগ্রহ থাকলেও অভাবের তাড়নায় তা আর হয়ে ওঠেনি। এখন তার বয়স ৫৬ বছর। কিন্তু তিনি তার স্বপ্ন থেমে যেতে দেননি।
চা-দোকানি আব্দুর রশিদের ছেলেদের একজন সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আরেক ছেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিদ্যুৎ প্রকৌশলে পাস করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা বাজারে আব্দুর রশিদের চায়ের দোকান। সন্তানদের সাফল্যে তিনি নিজের কষ্ট ভুলে গেছেন। এ মাসে চায়ের দোকান ছেড়ে বিশ্রামে যাওয়ার কথা তার।
আব্দুর রশিদ নিউজবাংলাকে জানান, আট ভাই, এক বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। সংসারের ঘানি টানতে বাবাকে সহযোগিতা করতে খেলার বয়সেই কাজ করতে হয়েছে তাকে। গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে শুরু করে দিনমজুরি, রিকশা-ভ্যান চালানো সবই করেছেন তিনি।
একসময় সংসার পাতেন। প্রথমে যমজ ছেলের জনক হন তিনি। পরে আরও এক ছেলে হয় তার। ১৯৯৪ সালে রাজধানীর মিরপুরের আজরাবাদে চায়ের দোকানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রবেশ করেন। দুই ছেলে ‘মিরপুর সিদ্ধান্ত স্কুল’ থেকে এসএসসি ও আরেক ছেলে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর আব্দুর রশিদ নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে চলে আসেন। পরে ছেলেরা সরকারি তোলারাম কলেজ আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
আব্দুর রশিদ বলেন, ‘বড় ছেলে রাজিব হোসেন ৩৮তম বিসিএস পাস করেছে। তবে আগে থেকেই বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে চাকরি করে সে। যমজ ছেলের আরেকজন হোসেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ব্যবসা করে।’
আব্দুর রশিদের ছোট ছেলে মাহমুদুল হাসান বুয়েট থেকে ইলেকট্রনিক্স-ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করেছেন। তিনিও এবারের বিসিএস পরীক্ষার্থী। ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নের মুসলিমনগরে পৈতৃক ভিটায় থাকেন তারা।
নারায়ণগঞ্জে বাড়িতে ফিরে আব্দুর রশিদ প্রথমে বিসিক শিল্প নগরীর একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করেন। কিছুদিন পর ফতুল্লা বাজারে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে চায়ের দোকান দেন। সেই থেকে গত দশ বছর একটানা এ ব্যবসায় ব্যস্ত তিনি।
আব্দুর রশিদ বলেন, ‘সন্তানদের মানুষ করতে আমার স্ত্রীর অবদান সবচেয়ে বেশি। সন্তানেরা শুধু লেখাপড়াতেই ডিগ্রি নেয়নি, দেশ ও মানুষের প্রতি তাদের মমত্ব দেখে আমি বিস্মিত।’
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমি ছেলেদের একবার বলেছিলাম উন্নত কোনো দেশে যেতে। ছেলে জবাব দিয়েছিল, “বাবা আমাদের লেখাপড়া শেখাতে তুমি যেমন খরচ করেছ, তার চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে রাষ্ট্রের। আর এ টাকা জনগণের। এ ঋণ পুরোপুরি শোধ করা সম্ভব নয়, তবে আমার মেধা এ দেশের জন্য কাজে লাগাতে হবে।”’
ছেলেদের পরামর্শে আব্দুর রশিদ তার দোকানে পান, সিগারেট বিক্রি করেন না। দোকানের দেয়ালে সাদা কাগজে লেখা রয়েছে, এই দোকানে ধূমপান নিষেধ। চলতি মাসে চায়ের দোকান ছেড়ে অবসরে যাচ্ছেন তিনি। ছেলেদের অনুরোধ হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন বাবা।
তবে আব্দুর রশিদের দোকান ছাড়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে ফতুল্লা বাজারজুড়ে। আশপাশের দোকানি ও স্থানীয়রা এসে সময় কাটাচ্ছেন তার সঙ্গে।
ডিম ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, ‘সকালে বাসা থেইকা আইসা রশিদ ভাইয়ের চা না খাইলে মেজাজ ভালো কাটত না। তার দোকান থেইকা বাজারের সবাই চা খায়। তিনি চা-দোকানি কইরা ছেলেগো লেখাপড়া করাইছে। তার ছেলেরা দোকানে এলে সবাই ওদের দেখতে আসে। শুনছি, রশিদ ভাই নাকি দোকান ছাইরা দিব। এই জন্য তার সঙ্গে সময় কাটাইলাম। গত চার বছর ধইরা তার হাতের চা খাই।’
সুমন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ফতুল্লা থানার পিছনে রশিদ ভাইয়ের দোকান হওয়াতে পুলিশসহ বিভিন্ন লোকজন চা খাইতে যায় তার কাছে। অনেকের দুঃখকষ্টে সহযোগিতাও করেছেন উনি। তার স্বপ্ন আছিল, ছেলেগো অনেক লেখাপড়া করাইব। তার ছেলেরা এখন অকে বড় হইছে। এলাকার সবাই রশিদ ভাইরে দেখলে ভালোবাইসা সম্মান করেন।’
ফতুল্লা থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘রশিদ ভাইয়ের রং চায়ের কথা ভুলব না। শুনেছি তিনি দোকান ছেড়ে দিবেন। তাই প্রতিদিন তার দোকানে গিয়ে চা খেয়ে আসি। তার দুই ছেলের কথা অনেক শুনেছি। তারা রশিদ ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে সবার কাছে। ভালো থাকুক রশিদ ভাই।’