কথায় কথায় মারধর করা হয় বলে মাদ্রাসাই ছেড়ে দিচ্ছে রংপুরের গংগাচড়ায় একটি মাদ্রাসার দুই ছাত্র।
শিক্ষকের পিটুনিতে হাসপাতাল থাকা দুই ছাত্র জানিয়েছে, ২৯ মার্চ তারা পরীক্ষা দিতে যাবে। এরপর আর সেখানে পড়বে না।
শিশু দুটির বাবা-মা জানিয়েছেন, সন্তানদের তারা আর চাপ দেবে না। আর শিক্ষকরা তাদের কাছে অঙ্গীকার করেছেন, তাদের পেটানো হবে না। যদিও এই কথায় আস্থা রাখতে পারছে না শিশু ও তাদের অভিভাবকরা। আর এ কারণেই মাদ্রাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার ইয়াহিয়া উল-উলুম কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মোস্তাকিম বিল্লাহর পিটুনিতে আহত হওয়ার পর ১৩ মার্চ পালিয়ে যায় ১৪ এবং ১৩ বছরের দুই ছেলে।
দুইজন ঘুরতে ঘুরতে গংগাচড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুশান্ত কুমার সরকারকে পেয়ে তাকে সব খুলে বলে। পরে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৬ দিন পর ১৯ মার্চ একজনকে আর পরদিন আরেকজনকে নিয়ে যায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
পরিবারের অমত থাকলেও মাদ্রাসাটির প্রধান মাওলানা তাজুল ইসলাম নিজেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে তাদের মাদ্রাসায় নিয়ে যান। তারা এখন হাফেজ রবিউল ইসলামের হেফাজতে আছে। তিনি তাদের দেখভাল করছেন।
আহত এক ছাত্র বলে, ‘আমি গত বুধবার হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাই। শরীরে ও পায়ে একটু ব্যথা ছিল। বাড়িত যাবার পর আসতে মন চায় নাই। মাদ্রাসার বড়হুজুর আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথা বলছে। হুজুর নাকি বলছে আর কোনো সমস্যা হবে না। এই জন্য আব্বা আবার পাঠাইছে।
‘২৯ তারিখ হাফেজ হওয়ার পরীক্ষা আছে। পরীক্ষা দিয়েই বাড়ি যাব। আর মাদ্রাসায় আসব না।’
আরেক ছাত্র বলে, ‘আমরা দুইজন একসঙ্গে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাই। এখন ব্যথা নাই, দাগ আছে। বাবার সঙ্গে বড়হুজুর কথা বলছেন। আমি শনিবার বিকালে মাদ্রাসায় আসছি। বাবাকে বলছি, ২৯ তারিখ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাব। বাবা বলছেন, ঠিক আছে।’
তার মা বলেন, ‘অমন করি কাইও (কারও) ছাওয়াক (সন্তান) মারে। মনটায় চায় নাই ফির (আবার) মাদ্রাসাত দেই। কয়দিন পর ছাওয়াক হাফেজ নাকি হবে। বড়হুজুর কইছে আর ওমাক কেউ মারবের নয়। ওই আশাতে দিছি, কিন্তু মনটা টেকোছে (ভালো লাগছে) না। কেমন যেন করে শরীরডা, ফির যদি মারে...।
‘এবার যদি ছাওয়াটাক মারে, হামরা ছাড়বের নই। মামলা করছি, ওই হুজুরটের যেন বিচার হয়।’
আহত আরেক ছাত্রের বাবা বলেন, ‘আমি তো আর ওই মাদ্রাসাত দিবের চাই না। হামাক কইছে, তোমার ছৈলের যদি কোনো সমস্যা হয় তাইলে জানাবে, এই জন্য দিচি। পরীক্ষা দিলে পরে সিদ্ধান্ত টানমো (সিদ্ধান্ত নিব)। ওটি (ওখানে) রাখব কি না।
মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা তাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছেলে দুটি হেফজি (কোরআন মুখস্থ) শেষ করেছে। ২৯ মার্চ তাদের পরীক্ষা (শুনানি) হবে। এ কারণে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মাদ্রাসায় আনা হয়েছে। ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত, আর এমন ঘটনা ঘটবে না।’
নির্যাতনকারী শিক্ষকের চাকরি থাকবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা কমিটির বিষয়।’
১৩ মার্চ ভোরে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় একজনকে ও সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পানির হিটার অন্য হুজুরকে দেয়ায় আরেকজনকে বেধড়ক মারধর করেন শিক্ষক মোস্তাকিম বিল্লাহ।
পিটুনি থেকে বাঁচতে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, মাদ্রাসা থেকে পালানোর। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে বের হয়ে দুইজন হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় গংগাচড়া থানার পাশে। সেখানে তাদের খুঁজে পান থানার ওসি সুশান্ত কুমার সরকার।
দুই শিশুর অবস্থা দেখে পুলিশের ওই কর্মকর্তা তাদের নিয়ে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে তাদের ভর্তি করেন চিকিৎসকরা।
এর মধ্যে থানা থেকে যোগাযোগ করা হয় দুই শিশুর পরিবারের সঙ্গে। এ ঘটনায় ওই দুই ছাত্রের একজনের বাবা ১৪ মার্চ গংগাচড়া থানায় গিয়ে শিক্ষক মোস্তাকিমের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
গংগাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসিফ ফেরদৌস বলেন, ‘শিশু দুটির শারীরিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তাদের বুধবার হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। আঘাতের চিহ্ন ধীরে ধীরে মুছে যাবে।’
গংগাচড়া মডেল থানার ওসি সুশান্ত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, আর যেন কোনো শিশুকে এভাবে নির্যাতন করা না হয়। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা এসব বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি।’