সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে হামলার ক্ষেত্র তৈরি এবং দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুক্রবার রাতে দিরাইয়ের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।ওই সমাবেশে আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় নেতাও সহযোগিতা করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এ তথ্যের যাচাই করতেই তাদের সঙ্গে আলাপ।এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময়েই রাত ১১টার দিকে দিরাই থেকে এক যুবলীগ নেতা কল দেন। কল দিয়ে তিনি জানান, শাল্লায় হামলা ও ভাঙচুরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকা শাল্লার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম স্বাধীন (স্বাধীন মেম্বার) পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান। স্বাধীনের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে সহযোগিতা চান তিনি।ওই যুবলীগ নেতার সঙ্গে আলাপের কিছুক্ষণ পরই কল দেন আলোচিত স্বাধীন মেম্বার। স্বাধীন বলেন, ‘আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই। এ ব্যাপারে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি।’
কয়েক হাজার মানুষ দা-লাঠিসহ মিছিল নিয়ে এসে ভাঙচুর করে ৮৭টি হিন্দু বাড়ি। ছবি: নিউজবাংলা
স্বাধীন জানান, তিনি কুলাউড়ায় রয়েছেন এবং কোতোয়ালি থানা-পুলিশের সঙ্গে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে কথা বলেছেন।এরপর নিউজবাংলার সিলেট ব্যুরোপ্রধান কথা বলেন সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি মোসাইদ রাহাতের সঙ্গে। স্বাধীন পরিচয়ে যে নম্বর থেকে কল দেওয়া হয়েছে, সেটি আসলেই স্বাধীনের কি না, সেটি জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।
রাহাত শাল্লার হামলাকবলিত ওই এলাকা ঘুরে এসেছেন। স্বাধীনের ব্যাপারেও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি। রাহাত নিশ্চিত করেন, এটি স্বাধীনের নম্বর।সঙ্গেই সঙ্গেই কল দিই সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। তিনি জানান, স্বাধীন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে তিনি (স্বাধীন) আত্মসমর্পণ করতে চাইলে পুলিশ সহায়তা করবে।
একই ধরনের কথা বলেন কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও। কুলাউড়ায় স্বাধীনের অবস্থান সম্পর্কিত কোনো তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান।এরপর মোসাইদ রাহাত কথা বলেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমানের সঙ্গে। মিজানুরও জানান, স্বাধীন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে তিনি আত্মসমর্পণ করতে চাইলে পুলিশ তাকে সব ধরনের সহায়তা করবে। এমনকি তিনি যে জায়গায় আছেন, সে জায়গায় গাড়ি পাঠানো হবে।রাহাতকে এসপি অনুরোধ করেন, তিনি যেন স্বাধীনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। সম্ভব হলে রাহাত যেন গাড়ি করে গিয়ে স্বাধীনকে নিয়ে আসেন।সব ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান এসপি।
কয়েক হাজার মানুষ দা-লাঠিসহ মিছিল নিয়ে এসে ভাঙচুর করে ৮৭টি হিন্দু বাড়ি। ছবি: নিউজবাংলা
রাহাত এই কথা জানানোর পর আমি (নিউজবাংলার সিলেট ব্যুরোপ্রধান) আবার কথা বলি স্বাধীন মেম্বারের সঙ্গে। সুনামগঞ্জের এসপির বক্তব্য তাকে জানানোর পর তিনি এসপির সাথে যোগাযোগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি তাকে এসপির নম্বর দিই।এরপর দিরাইয়ের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ মিয়াও ফোন করে অনুরোধ করেন, স্বাধীনের সঙ্গে আলাপ করে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে।এরপর আবার স্বাধীনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।এর কিছুক্ষণ পর স্বাধীন আবার কল দিয়ে জানান, তিনি এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা তাকে নিয়ে যেতে আসছেন।তবে কোন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন তার নাম জানাতে পারেননি তিনি।এভাবে রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কয়েকবার কল দিয়ে কথা বলেন স্বাধীন। তবে আমি কল দিতে গেলেই তার ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম।এরপর যখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন, রাত ২টা ১৭ মিনিটে কল দেন র্যাব-৯-এর মিডিয়া কর্মকর্তা এএসপি ওবাইন।তিনি কল দিয়ে বলেন, ‘আপনি কোথায় আছেন। আপনার সাথে জরুরি প্রয়োজন।’বাসায় আছি জানালে বলেন, ‘আমি আপনার বাসায় আসি। বাসার ঠিকানা বলেন?’
শাল্লা হিন্দুপল্লিতে হামলা করতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসছে হেফাজত সমর্থকরা। ছবি: সংগৃহীত
এত রাতে র্যাব কর্মকর্তা বাসায় আসার কথা শুনে প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। আধা ঘণ্টার মধ্যেই র্যাব-৯-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মো. আসাদুজ্জামানসহ আরও দুজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বাসার সামনে হাজির এএসপি ওবাইন।তারা স্বাধীন মেম্বারের ব্যাপারে তথ্য জানতে চান। আমি আমার সঙ্গে স্বাধীনের আলাপচারিতার সব তথ্য তাদের জানাই। তাদের অনুরোধে আমি স্বাধীনের মোবাইলে আবার কল দিই। তবে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।র্যাব-৯-এর অধিনায়ক আমাকে বলেন, ‘স্বাধীন কুলাউড়ায় আছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এখন তাকে গ্রেপ্তারে আপনার সহযোগিতা চাই।’তিনি বলেন, ‘স্বাধীনের সাথে অন্য লোক দিয়ে আমরা যোগাযোগ করেছি। সে আপনার উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করতে চায়।’আমি তাকে জানাই, ‘স্বাধীনের সাথে আমার কোনো পরিচয় নাই। আজকেই প্রথম কথা হয়েছে। শাল্লার ঘটনার আগে তার নামও আমি জানতাম না।’জবাবে র্যাব অধিনায়ক বলেন, ‘সে কোনো কারণে আপনাকে বিশ্বাস করেছে। এখন আপনার উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করতে চায়।’আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই মোবাইল ফোনে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন র্যাব-৯-এর অধিনায়ক।এরপর তিনি আমাকে তাদের সঙ্গে কুলাউড়া যেতে অনুরোধ করেন।আমি নিউজবাংলার সহসম্পাদক রাকিব খানকে অবহিত করে তাদের সঙ্গে কুলাউড়া যেতে সম্মত হই।তারা আমাকে বাসা থেকে প্রথমে নিয়ে যান র্যাব-৯-এর প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে তারা যখন অভিযানে যাওয়ার জন্য গাড়ি ও টিম প্রস্তুত করছিলেন, তখনই র্যাব-৯-এর অধিনায়কের মোবাইলে বার্তা আসে স্বাধীন গ্রেপ্তার হয়েছে।পরে জানতে পারি স্বাধীনকে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কুলাউড়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে।এরপর র্যাব কর্মকর্তারা গাড়ি করে আমাকে আবার বাসায় পৌঁছে দেন।আর স্বাধীনকে গ্রেপ্তারের তথ্যটি সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি রাহাতকে নিশ্চিত করেন পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ-উজ জামান।
কে এই স্বাধীনএবার স্বাধীন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুদের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসে ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম স্বাধীনের (স্বাধীন মেম্বার) নাম।তাণ্ডবের পরদিন স্থানীয় হবিবপুর ইউপির চেয়ারম্যানের করা মামলায়ও স্বাধীন মেম্বারকে আসামি করা হয়।শহীদুল ইসলাম স্বাধীনের বাড়ি শাল্লার পাশে দিরাই উপজেলার নাচনি গ্রামে।হেফাজত ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে এক যুবকের দেওয়া স্ট্যাটাসের জেরে ১৭ মার্চ শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজারও লোক মিছিল নিয়ে এসে এই হামলা চালায়।স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, হামলাকারীদের বেশির ভাগই আসে স্বাধীনের গ্রাম দিরাইয়ের নাচনি থেকে। স্বাধীন মেম্বারও হামলাকারীদের দলে ছিলেন। তার উপস্থিতিতেই হামলা হয়।স্বাধীন মেম্বারের সঙ্গে জলমহাল নিয়ে নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধের জেরে মামুনুল অনুসারীদের সঙ্গে তিনি এই হামলায় অংশ নেন বলেও অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের।
স্বাধীন ও তার পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী। প্রভাব খাটিয়ে এলাকাবাসীকে হয়রানি-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে স্বাধীন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে।এদিকে ঘটনার পর থেকেই এলাকা ছাড়েন স্বাধীন। নিউজবাংলার সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি দিরাইয়ে স্বাধীনের বাড়িতে গিয়েও তাকে পাননি।তবে আলাপকালে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে শহীদুল ইসলাম স্বাধীন বলেন, ‘এই ঘটনায় আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। ঘটনার সময় আমি বাড়িতেই ছিলাম। হেফাজতের মিছিলের খবর পেয়ে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে ঘটনাস্থলে যাই। সে সময় আমি মিছিলকারীদের থামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো হামলায় অংশ নিইনি।’স্বাধীন বলেন, ‘জলমহাল নিয়ে নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর সাথে আমার বিরোধ হয়েছে। এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। তবে এই বিরোধের জের ধরে হামলায় অংশ নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।’
হামলার কোনো ছবি বা ভিডিও ফুটেজেই তাকে পাওয়া যাবে না বলে দাবি স্বাধীনের।১৫ মার্চ দিরাইয়ে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। এতে বক্তব্য দেন সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। পরদিন মামুনুলের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন নোয়াগাঁওয়ের এক যুবক।
এই স্ট্যাটাসের জেরে হিন্দু-অধ্যুষিত ওই গ্রামটিতে হামলা চালিয়ে ৮৭টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এ ঘটনায় দুটি মামলায় এখন পর্যন্ত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।