বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘হেই কষ্টের দিনগুলা আর মনে করতে চাই না’

  •    
  • ১৯ মার্চ, ২০২১ ০৯:১৮

গত বছরের ১৩ই মার্চ শিবচরে ইতালি ফেরত এক ব্যক্তির দেহে করোনা শনাক্ত হয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ দেশে শনাক্ত হওয়া ১৭ জন করোনা রোগীর মধ্যে আটজনই ছিলেন শিবচরের। এ কারণে দেশে সবচেয়ে প্রথম লকডাউন করা হয় শিবচর উপজেলাকে।

অল্প আয়ের সংসার। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার, তা দিয়েই চাল-ডাল কিনে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু দিকে লকডাউনে আটকা পড়ে দুর্বিষহ দিন কেটেছে রানা বেপারীর।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুটা মাদারীপুরের শিবচরে। করোনা এলোমেলো করে দিয়েছিল এই উপজেলার জনজীবন। এক বছর পার হলো, কিন্তু সেই কষ্টের দিনগুলো এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় সেখানকার মানুষদের।

দিনগুলোর কথা মনে করে নিউজবাংলাকে রানা বলেন, ‘হারা জীবনেও ওই দিনগুলার কথা ভোলতে পারমু না।

‘আমার বাড়িওয়ালীর (স্ত্রী) তখন সিজারে বাচ্চা হইছে, তার ওপর ছেলের অইছে অসুখ। আয় রোজগার সব বন্ধ, গাড়ি চালাইতে পারি না। চাউল কিন্না আনমু নাকি সিজারের খরচ দিমু, নাকি ছেলেরে চিকিৎসা করামু, চোখে খালি আন্দার দেখছি ভাই।’

লকডাউনের তিন মাস ভ্যান চালাতে পারেননি জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কখনও ভ্যান নিয়ে রাস্তায় বের হলেও যাত্রী না পাওয়ায় অর্থ কষ্টে কেটেছে সেসব দিন।

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের আট মার্চ। দেশের করোনার সংক্রমণের শুরুর ধাক্কাটা বেশি দেখা যায় মাদারীপুরের শিবচরে।

ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছর মার্চ থেকে ইতালি, গ্রিস, স্পেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি ফিরে এসেছিলেন। তাদের বেশির ভাগই ছিল মাদারীপুরের। ১৩ই মার্চ শিবচরে ইতালি ফেরত এক ব্যক্তির দেহে করোনা শনাক্ত হয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ দেশে শনাক্ত হওয়া ১৭ জন করোনা রোগীর মধ্যে আটজনই ছিলেন শিবচরের।

এ কারণে দেশে সবচেয়ে প্রথম লকডাউন করা হয় শিবচর উপজেলাকে। হঠাৎ টেলিভিশনে লকডাউনের খবর শুনে উপজেলার বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে যায়।

হাট-বাজার, শিক্ষা-সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হল। শুধু খোলা ছিল ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান। তাও আবার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।

শিবচরবাসী হয় গৃহবন্দী। রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয় আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনী। সবার মনে নতুন রোগটি নিয়ে আতঙ্ক।

এক বছর আগের ওই দিনগুলোর কথা মনে করে শিবচর বাজরের কাপড়ের ব্যবসায়ী রেজাউল ব্যাপারী বলেন, ‘৭ লাখ টাকা খরচ কইরা দোকান দিছি, দোকান ছাড়া আমাগো আর কোন আয় রোজগার নাই। করোনার তিন মাস দোকান বন্ধ থাকায় বড় কষ্টে কাটাইছি। আমরা ব্যবসায়ী দেইক্কা আমাগো কেউ দুই কেজি চাউলও দেয় নাই। কম অইলেও এই তিন মাসে ৪-৫ লাখ টাকা বেচা-বিক্রি করতে পারতাম। দিনগুলা খুব কষ্টে কাটাইছি। এখন মোটামুটি বেচা বিক্রি অয়। বেশি একটা অয় না। মানুষের হাতে আগের মত টাহা পয়সা নাই।’

বাজারের চায়ের দোকানী মোতাহার হোসেন মুন্সী বলেন, ‘হারা করোনার লকডাউনে মাত্র ৩০ কেজি চাউল পাইছি। পুলিশের ডরে দোকান খোলতে পারি নাই। পোলা মাইয়া লইয়া অনেক কষ্ট অইছে। এহন আল্লায় ভালই রাকছে। হেই কষ্টের দিনগুলা আর মনে করতে চাই না।’

লকডাউনের সময় ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন শিক্ষার্থীরা। শিবচর বরহামগঞ্জ সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জায়েদ বিন শাহীদ বলেন, ‘সারা বছর পড়াশোনা করে যখন ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখনই লকডাউন ঘোষণা করা হল। সারাদিন ঘরে বসে থাকতাম। দেশের সার্বিক চিন্তায় তেমন পড়াও হত না।

‘দিন যতই বাড়তে থাকল ততই আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়তে থাকল। আমাদের পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে গেল। ঘরে বসে সারাদিন শুয়ে বসে সময় কাটাতে হত। আমরা সবাই পরীক্ষার চিন্তার চেয়ে বেঁচে থাকার চিন্তাই বেশি করেছি। তারপর যখন সরকার আমাদের অটো প্রমোশনের ঘোষণা দিল, তখন কিছুটা স্বস্তি পেলাম।’

পাচ্চর ইউনিয়নের বড় বোয়ালী গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রীস আলী বেপারী বলেন, ‘জীবনে এত দিন ঘরে থাকি নাই। দরকার একটু বাজারে যাইতাম আবার কেনাকাটা কইরা বাড়িতে চইলা আসতাম। নতুন রোগ, কোন ওষুধও আবিষ্কার হয় নাই, তাই খুব ভয় থাকতাম। এখন তো আল্লাহর অনেক রহমত করছে।’

শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘শিবচরের মানুষ ভালো একটা সাপোর্ট পেয়েছে করানোর সময়। এখানেই রোগীরা করোনা টেস্ট করতে পেরেছে। প্রথমে আমরা কিছু করোনা রোগীকে ইনডোরে চিকিৎসা দিয়েছি। তারপর এখানকার লোকাল রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসন সবাই মিলে একটা ডিসিশন নেয় যে, একটা আইসোলেশন সেন্টার করে সেবা দিলে সাধারণ রোগীরা সেইফ থাকবে; স্বাস্থ্যকর্মীরাও নিরাপদ থাকবে।

‘সেই হিসেবে বহেরাতলা মা ও শিশু হাসপাতাল যেখানে হওয়ার কথা ছিল সেখানে ২০ শয্যা বিশিষ্ট একটি আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়। ওখানে আমরা করোনা রোগীদের রেখে সেবা দিয়েছি। আমাদের ডাক্তার এবং নার্সরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে।’

সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (শিবচর সার্কেল) আমির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায় শিবচরে। আমরা প্রথমত ওই শনাক্ত হওয়া রোগীদের বাড়িগুলোকে লকডাউন করি এবং তারা যাদের সঙ্গে যারা চলাফেরা করেছে তাদের লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসি।

‘প্রতিটি বাজার এবং মার্কেট সীমিত সময়ের জন্য চালু রেখেছি। মানুষকে মাস্ক পরিধান করতে বাধ্য করেছি। মসজিদগুলোতে যাতে সীমিত সংখ্যক মুসল্লি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ আদায় করে সে বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করেছি। কাঁঠালবাড়ি ঘাটে কিছুদিনের জন্য আমরা লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছিলাম… সার্বিকভাবে আমরা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।’

লকডাউন ও আতঙ্কের দিন কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন শিবচরবাসী। অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ।

এ বিভাগের আরো খবর