পিটিয়ে পাঁজরের হাড় ভেঙে ফেলার পর ১০ বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যুর পর শিশুদের পিটুনি থামিয়েছে দুই বছর আগে আলোচিত হয়ে ওঠা ময়মনসিংহের ভালুকার একটি কওমি মাদ্রাসা।
তবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শিশুদের মগজ ধোলাই করে ‘মার দেয়া খারাপ কাজ ছিল না’- এই জাতীয় কথা শেখানোর অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে প্রাণ হারানো শিশুর এক সহপাঠী বলেছে, সে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার চায় না। শিক্ষকরা তাদের বলেছেন, ছেলেটিকে মারা হয়েছিল তার ভালোর জন্য।
পড়া না শেখায় ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভালুকার জামিরদিয়া মাদ্রাসায়ে ওমর (রা.) হাফিজিয়া অ্যান্ড ইসলামি কিন্ডারগার্টেনের নূরানী বিভাগের ছাত্র তাওহিদুল ইসলামকে বেদম পেটানো হয়।
এ সময় ১০ বছর বয়সী শিশুটির পাঁজরের হাড় ও একটি পা ভেঙে যায়। ৪ মার্চ ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তাওহিদ।
এই ঘটনায় মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে সপ্তাহ তিনেক পরে সেটি চালু হয় বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসার সহকারী সুপার ইমরান হোসাইন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেছেন, ‘এই ঘটনায় মাদ্রাসা কমিটি থেকে বলা হয়েছে কোনো ছাত্রকে কোনো প্রকার বেত্রাঘাত করা যাবে না।’
কওমি মাদ্রাসায় শিশুদের নির্মমভাবে পেটানো ও বলাৎকারের অভিযোগ নতুন নয়। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও আসার পর এই বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।
ইদানীং ভুক্তভোগী শিশুরা বা তাদের পরিবারগুলোর মধ্যে মামলা করার প্রবণতা বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে এই ধরনের তিনটি ঘটনা এসেছে গণমাধ্যমে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও সাতকানিয়ায় দুটি ও রংপুরের গঙ্গাচড়ায় একটি মাদ্রাসায় ছাত্রদের পিটুনির ঘটনায় তিনজন শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে মামলা।
এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকার আশুলিয়ায় একটি মাদ্রাসার কথা। গত সেপ্টেম্বরে দুই শিশুকে নির্মমভাবে পেটানোর ভিডিও প্রকাশের পর ওই মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। মাস তিনেক আগে সেই মাদ্রাসাটি চালু হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুপার বলেছেন, তারা এখন আর পেটান না।
মামলা হলেও বিচার শেষ হয়নি
ভালুকার সেই শিশুটির মৃত্যুর পরদিন শিক্ষক আমিনুল ইসলাম রাসেল ও মাদ্রাসা সুপার মুফতি এনামুল হককে আসামি করে ভালুকা থানায় মামলা করেন নিহত তাওহিদের বাবা কয়েস মিয়া।
তবে পুলিশ মাদ্রাসা সুপারকে বাদ দিয়ে ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর মামলার অভিযোগপত্র দেয়। আর এ কারণে এই প্রতিবেদনে নারাজি দেন কয়েস মিয়া।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, তাওহিদকে মারধরের সময় সুপার এনামুল হক ছুটিতে থাকায় মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বেত্রাঘাতের পর অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার জন্যই তাওহিদের মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তথ্য এসেছে।
বাদী আইনজীবী কতুব উদ্দিন বলেন, তাওহিদকে মারধরের বিষয়ে সুপার এনামুল হক অবগত ছিলেন। তাই তাকে বাদ দেয়ায় নারাজি দেয়া হয়েছে। আশা করছি তাওহিদ হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
মাদ্রাসার সহকারী সুপার ইমরান হোসাইন ঘটনাটিকে অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে বলেন, ‘এই ঘটনায় জড়িত নূরানী বিভাগের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম রাসেলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তিনি এখন জেলে।
‘এই ঘটনায় আমাদের মাদ্রাসা ২০-২৫ দিন বন্ধ ছিল, পরে এলাকাবাসী ও মাদ্রাসা কমিটির সিদ্ধান্তে মাদ্রাসা চালু আছে।’
যা বলছেন শিশুর স্বজনরা
নিহত শিশুটির বাবা কয়েস মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। হোটেলে কাম করি। নিজের শিক্ষা নাই, পুলারে মাদ্রাসায় দিছিলাম মানুষ হওয়ার লাইগ্যা। কিন্তু যারার কাছে দিছিলাম তারাই আমার সন্তানরে মাইরালচে, আমি তার বিচার চাই।’
তাওহিদের মা হাসনা হেনা বলেন, ‘আমার পুলা মরণের আগের দিন আমারে কইছে, ‘‘হুজুর আমারে মারছে, পরে কইছে আমি যদি বাইত (বাড়িতে) কই, তাইলে অক্করে (একেবারে) মাইরালব। হেল্লাইগ্যা আমি ডরে তোমাদের কইছি না।'”
তাওহিদের দাদি সমর্তা বানু বলেন, ‘আমার দাদাভাই আমারে কইত, ‘‘দাদু, তুমি মরলে আমি তোমার জানাজা পড়ায়াম, তোমার কবরে পাশে গিয়া দোয়া পড়বাম, বাইরেততে হুজুর আনন লাগব না।'' আইজ কই আমার দাদাভাই? যে হুজুরের কাছে আমার দাদাভাইরে আলেম বানাইতে দিছিলাম, এই হুজুররাই আমার দাদাভাইরে মাইরালচে।'
বন্ধুর মৃত্যুতে কষ্ট হয় তাওহিদের সহপাঠী মারুফ বিল্লালের। কিন্তু সে হুজুরের বিচার চায় না। কারণ জানতে চাইলে সে বলে, হুজুরের বিচার হলে আলেম সমাজের বদনাম হবে।