এ যেন গায়েহলুদের কনে। মুখটা হলুদ আর শরীরে সবুজ শাড়ি। হঠাৎ দেখায় এমন মনে হতেই পারে। যদিও আদতে তেমন কিছুই নয়। সবগুলোই ফুল গাছ। সবুজ-হ্যাংলা গাছের চূড়ায় বিরাট হলদে ফুল। পৃথিবীর মতো গোলাকার ফুলগুলো চেয়ে আছে সূর্যের দিকে। নাম তার সূর্যমুখী।
দেশে আজকাল এই সূর্যমুখীর চাষ বেড়েছে। কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও চাষ হচ্ছে এই ফুলের। দেশে ভোজ্যতেলের সংকট নিরসনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও সূর্যমুখী চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
প্রণোদনা আর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। সূর্যমুখীর তেলের বাজারও বড় হচ্ছে দেশে। বাড়ছে চাহিদা। রূপ আর তেল দুই-ই ঢেলে দিচ্ছে সূর্যমুখী। এতে সন্তুষ্ট পর্যটক ও কৃষক। ফলে দেশে সূর্যমুখী চাষ আরও বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
শেরপুর, নরসিংদী, মৌলভীবাজার, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারীসহ আরও অনেক স্থানে আবাদ হচ্ছে সূর্যমুখীর।
শেরপুর
কৃষি বিভাগের প্রণোদনার আওতায় শেরপুরের পাঁচটি উপজেলায় ১৫৪ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে সূর্যমুখীর। ইতিমধ্যে প্রতিটি গাছে ফুল ফুটেছে। হেক্টরপ্রতি দেড় থেকে দুই টন বীজ হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
কৃষক আব্দুল হালিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ২০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করছি। খরচ খুব কম। লাভও অইব বেশি। আগামীতে অন্তত এক একর জমিতে ফুলের চাষ করমু।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মোহিত কুমার দে জানান, এ জেলায় সূর্যমুখী ফুলের চাষাবাদ একেবারেই নতুন। আবাদ বাড়াতে প্রণোদনা ও পুনর্বাসনের আওতায় বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেয়া হচ্ছে।
সূর্যমুখী চাষে কুমিল্লাও পিছিয়ে নেই। ছবি: মাহফুজ নান্টু/নিউজবাংলানরসিংদী
জেলার নাগরিয়াকান্দি এলাকার কামারগাঁওয়ে বিশাল এলাকায় সূর্যমুখী ফুল ফুটেছে। ফুলের রং ও ঘ্রাণ টানছে দর্শকদের।
সূর্যমুখী ক্ষেতের মালিক সাইদুর রহমান শিমুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করেছি। যা দেখতে প্রতিদিন শ শ দর্শনার্থী ভিড় করছেন।’
সদর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘সূর্যমুখী চাষের ফলে এ জায়গা পিকনিক স্পটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের সমাগম হচ্ছে।’
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শোভন কুমার ধর বলেন, ‘সূর্যমুখীর বৈজ্ঞানিক নাম হলো হেলিয়ান্থাস অ্যানুয়াস। রোগবালাই খুব কম হয় এই ফুলের। সূর্যমুখী বীজ বপনের ৬৫-৭০ দিন পর গাছের ফুলে বীজ পুষ্ট হওয়া শুরু হয়।
ফসল তোলার সময় হলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে আসে। ফুলসহ গাছের পাতা নুয়ে পড়ে। বীজগুলো কালো ও দানাগুলো পুষ্ট এবং শক্ত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নরসিংদীতে এ বছর ২৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে সদর উপজেলায়।
নীলফামারীতে মাঠের পর মাঠ চোখে পড়বে এমন সূর্যমুখীর বাগান। ছবি: নিউজবাংলামৌলভীবাজার
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৌলভীবাজারে এ বছর হাইসান-৩৩, হাইসান-৩৬ ও আরডিএস-২৭৫ হাইব্রিড জাতের সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছে। জেলার সাতটি উপজেলাতেই হচ্ছে সূর্যমুখীর চাষ।
তবে আরডিএস-২৭৫ জাতের গাছে ফুল বেশি এলেও ফলন ভালো হয়নি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
কৃষি কর্মকর্তারাও বলছেন, পরীক্ষামূলকভাবে আরডিএ-২৭৫ কৃষকদের চাষ করতে বলা হয়েছে, সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে হয়তো ফলন ভালো হতো।
২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলাজুড়ে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে মাত্র ৫৮ হেক্টর জমিতে। কিন্তু এ বছর ৫৬৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।
সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের আজমেরু গ্রামে ২৫ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছেন সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহিন ও এস এম উমেদ আলী।
হুমায়েদ বলেন, আগে অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান তোলার পর জমিগুলো পড়েই থাকত। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে তারা দুই বছর ধরে সূর্যমুখী চাষ করছেন। গত বছর ভালো ফলন পেলেও দাম তেমন পাননি। তবে এ বছর ভালো দাম পাওয়ার আশা করছেন।
উমেদ আলী বলেন, আরডিএস-২৭৫ জাতের পরীক্ষামূলক চাষ করছেন। প্রতিটি গাছে অনেক ফুল এলেও সবগুলো পরিপক্ব হচ্ছে না।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী নিউজবাংলাকে জানান, প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৪ টন বা প্রতি বিঘায় ৮ মণ সূর্যমুখী বীজ পাওয়া যাবে।
কিশোরগঞ্জে এ বছর প্রায় ৩৩৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে। ছবি: রাকিবুল হাসান রোকেল/নিউজবাংলা
মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জের সদর, সাটুরিয়া, শিবালয়, দৌলতপুর, ঘিওর, হারিরামপুর ও সিঙ্গাইর উপজেলায় ৭৬ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৫২ মেট্রিক টন।
ঘিওর উপজেলার বাইলজুরি গ্রামের কৃষক বখতিয়ার হোসেন বলেন, প্রদর্শনী হিসেবে গত বছর এক বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুল চাষ করেন তিনি। সার, বীজ নিয়ে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ করে ১৫ মণ বীজ পান। বিক্রি করেন ৩০ হাজার টাকায়।
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহজাহান আলী বিশ্বাস মিঞা বলেন, কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। উপজেলা ও ফিল্ড অফিসাররা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
কিশোরগঞ্জ
মিঠামইন উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, সূর্যমুখী ফুলচাষে প্রতি একরে খরচ হয় ১২ হাজার টাকা।
সরকার কৃষকের মধ্যে বিনা মূল্যে বীজ দেয়ায় সূর্যমুখী চাষের আগ্রহ বেড়েছে। ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা যায় আবার বীজ থেকে উৎপাদিত তেলও খুব উপকারী।
তিনি আরও বলেন, সূর্যমুখী নতুন ফসল হওয়ায় সেটার চাষাবাদ সম্পর্কে নিয়মিত মাঠে গিয়ে কৃষকের জমিতে সার প্রয়োগ, আগাছা দমন, সেচ দেয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রম মনিটরিং করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলায় মোট ৩৩৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে ।
সূর্যমুখী বাগানে দর্শনার্থীদের ভিড়। ছবি: রাকিবুল হাসান রোকেল/নিউজবাংলানীলফামারী
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ২৬৫ হেক্টর জমিতে হচ্ছে সূর্যমুখী ফুলচাষ। উৎপাদিত ফসলের বীজ থেকে ভোজ্যতেল, খৈল থেকে মাছের খাবার, গাছ থেকে জ্বালানি আর পাতা থেকে হবে জৈব সার।
কুন্দুপুর ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের চাষি গোলাম রব্বানী বলেন, এ বছর প্রথম তামাকচাষের ১২ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছেন। তামাকের চেয়ে পরিশ্রম অনেক কম। ভালো দাম পেলে আগামী বছর বেশি বেশি চাষ করবেন।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা অমল রায় বলেন, সূর্যমুখী তেলে এইচডিএল লিপোপ্রটিন থাকায় মানবদেহে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, পতিত ও তামাকচাষের জমির মালিকদের সঙ্গে পরামর্শ করে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করতে সক্ষম হয়েছে কৃষি অধিদপ্তর। এবার কৃষকরা লাভবান হলে আগামীতে আরও বেশি তামাকচাষি সূর্যমুখী আবাদে আগ্রহী হবেন বলে তিনি আশা করেন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সাহায্য করেছেন শেরপুর প্রতিনিধি শাহরিয়ার শাকির, মৌলভীবাজারের এম এ হামিদ, মানিকগঞ্জের আজিজুল হাকিম ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি রাকিবুল হাসান রোকেল।