বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফুটবল মাঠ কাঁপানো সেই মেয়েদের কাঁধে শ্বশুরবাড়ির জোয়াল

  •    
  • ১৮ মার্চ, ২০২১ ০৮:২৩

স্বরলিকা নিউজবাংলাকে বলে, ‘ইচ্ছে ছিল জাতীয় দলে খেলার। কিন্তু এলাকার লোকজন নানা কথা বলত। বলত, মেয়েরা ফুটবল খেললে বিয়ে হবে না, ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না।’

বছর তিনেক আগে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর পাথরডুবি ইউনিয়নের সাবেক ছিটমহল দীঘলটারী দক্ষিণ বাঁশজানী গ্রাম পরিচিতি পায় নারী ফুটবলাদের গ্রাম হিসেবে। গ্রামকে এই পরিচিতি এনে দেয় বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একদল মেয়ে।

২০১৮ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে তৃতীয় হয় দলটি। কাপ না জিতলেও কোয়ার্টার ফাইনাল ও স্থান নির্ধারণী ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দেশসেরা খুদে ফুটবলার হয় বাঁশজানির স্বরলিকা পারভীন। তার হাতে সেদিন পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলে বাংলাদেশিদের পাওয়া প্রথম পুরস্কার স্বরলিকা।

সেই স্বরলিকার এখন ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর কথা থাকলেও স্বামীর সংসারের দায়িত্ব চেপেছে কাঁধে। হাইস্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বিয়ে হয় স্বরলিকার। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে এমন বিয়ের কারণে নিবন্ধনও (রেজিস্ট্রি) করেনি পরিবার। ধর্মীয় রীতিতে ৫ মার্চ মোটর মেকানিক কামরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।

ফুটবলের মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো স্বরলিকা এখন গৃহবধূ। ছবি: নিউজবাংলা

স্বরলিকার মতো তার দলের সাত ফুটবলারও এখন গৃহবধূ। তাদের পরিবারের দাবি, বাল্যবিয়ে দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ দারিদ্র্য। সংসারের খরচ কমাতে তারা মেয়েশিশুদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।স্বরলিকা নিউজবাংলাকে বলে, ‘ইচ্ছে ছিল জাতীয় দলে খেলার। কিন্তু এলাকার লোকজন নানা কথা বলত। বলত, মেয়েরা ফুটবল খেললে বিয়ে হবে না, ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না।’

স্বরলিকার বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, কৃষিকাজ করে পাঁচজনের সংসার চালান তিনি।

‘সীমান্ত এলাকা, এডে কোনো কামকাইজ নাই। করোনার জন্য অভাব আরও বেশি হইছে। ভালো ঘর পাইছি। ডিমান্ড ছাড়াই বিয়া দিছি মেয়ের।’

স্বরলিকাদের ফুটবল দলের আরেক ফুটবলার লিশামনির জন্য পাত্র খুঁজছে পরিবার।

প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া এই ফুটবল দলের সাতজনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। ছবি: নিউজবাংলা

লিশামনির মা আমিনা বেগম বলেন, ‘এই তিন বছর থাকি কেউ খোঁজ নেয়নি। স্কুল বন্ধ, পড়াশুনা নাই, মেয়েরা বসি থাকে। ভালো ছেলে পাইছে স্বরলিকার বিয়ে দিছে ওর বাপ-মা। আমিও ভালো ছেলে পাইলে আমার মেয়েকেও বিয়ে দেমো। হামারতো সামর্ত (সামর্থ্য) নাই যে, মেয়েকে পড়াশুনা করামো আর খেলোয়াড় বানামো।’

বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দলটিকে প্রশিক্ষণ দেন আতিকুর রহমান খোকন।

আক্ষেপভরা কণ্ঠে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অগোচরেই মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে তাদের পরিবার। এখন তাদের খেলার মাঠে থাকার কথা। অথচ অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। ওদের কারও মুখের দিকে তাকানো যায় না। কতগুলো সম্ভাবনা চোখের সামনেই শেষ।’

বাঁশজানি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কায়সার আলী বলেন, ‘করোনার সময় স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর তেমন নেয়া সম্ভব হয়নি। অনেকের বিয়ের খবর পরে জানতে পেরেছি। বিয়ের সময় জানতে পারলেও বিয়ে আটকানো যেত। আসলে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কিছু করার থাকে না।’

মেডেলগুলোর মতোই এখন বাক্সবন্দি স্বরলিকার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। ছবি: নিউজাবাংলা

জেলার রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা বাগবান্ধা গ্রামেও ঘটছে এমন বাল্যবিয়ের ঘটনা।

গ্রামের এক বাড়িতে পাওয়া গেল ১৩ বছরের রূপালী খাতুনকে। শ্বশুরবাড়ির মাটির চুলোয় মাছ ভাজতে ভাজতে সে কথা বলে নিউজবাংলার সঙ্গে।

রূপালী জানায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় গেল ডিসেম্বরে বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী বাসের হেলপার।

দিনমজুর হেলাল উদ্দিনের মেজো মেয়ে রূপালী। তার বড় বোন সোনালীর বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে।

সদর ইউনিয়নের চাকতাবাড়ি গ্রামের রৌমারী-ঢাকা মহাসড়কের পাশে সরকারি একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করেন তাদের বাবা-মা ও আরও পাঁচ ভাইবোন।

রূপালী বলে, ‘আমার বাবা-মায়ের থাকার জমি নেই। অভাবে পড়েই বিয়ে দিছে। স্কুলও বন্ধ। খাবারের সমস্যা। এ জন্যই বিয়ে দিছে।’

কুড়িগ্রামে করোনাকালে বেড়েছে বাল্যবিয়ে। ছবি: নিউজবাংলা

রূপালীর বাবা হেলালকে পাওয়া গেল ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। তিনি বলেন, ‘কাজকর্ম নাই। মেয়েকে যত বড় করমো, ততই ডিমান্ড বাড়বে। এখন স্কুলও বন্ধ। অভাবের মধ্যে খরচ বেশি হয়। সে জন্য মেয়েকে কম বয়সেই বিয়ে দিয়েছি। যৌতুক ৩০ হাজার টাকার মধ্যে নগদে ১৫ হাজার টাকা দিয়া বেটি পার করছি। বাকি টাকা আস্তে আস্তে দেমো।’প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এসব বাল্যবিয়ে কীভাবে হচ্ছে, জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, পরিবারগুলো তথ্য গোপন করে অন্য উপজেলায় গিয়ে বিয়ে দেয়। ভুয়া জন্মসনদ বানিয়ে নেয় অনেকে। এ জন্য পরে বিপদেও পড়তে হয়। কোনো কারণে বিয়েবিচ্ছেদ করতে হলে কাগজপত্রের অভাবে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে না অভিভাবকরা।

রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরবেশ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কয়েক মাসে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। লুকিয়ে অন্য উপজেলায় নিয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার দেখা যায়, শুধু হুজুর ডেকেই কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে।

ভূরুঙ্গামারীর পাথরডুবি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরফান আলী মনে করছেন সীমান্তবর্তী এই এলাকার বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বাড়ানো গেলে বাল্যবিয়ে কমে আসবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার দেব শর্মাও বললেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে হওয়ার পর তারা খবর পান না। বিয়ের সাক্ষী বা প্রমাণ পাওয়া যায় না বলে আইনি ব্যবস্থাও নেয়া যায় না।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বাল্যবিয়ে ঠেকাতে কড়া নজর রাখার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জরিপে উঠে আসে কুড়িগ্রামে বাল্যবিবাহের এই হিসাব। ছবি: নিউজবাংলা

বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম অফিসের হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৬১টি।

এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদরে ৬৪২টি, রাজারহাটে ৭২টি, উলিপুরে ২২৫টি, চিলমারীতে ১৩৮টি, রৌমারীতে ৮০টি, রাজিবপুরে ৪৭টি, নাগেশ্বরীতে ১০৭৮টি, ফুলবাড়ীতে ২৮২টি ও ভূরুঙ্গামারীতে ১৯৭টি বাল্যবিয়ে হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৭টি বিয়ে ঠেকানো গেছে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে।

সংস্থাটির কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের ‘বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস’ প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, করোনা পরিস্থিতিতে জরিপ ব্যাহত হওয়ায় জেলায় বাল্যবিয়ের সব হিসাব রাখা যায়নি। বাস্তবে আরও বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে।

করোনাকালে কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ে বাড়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনও।

কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী) আসনের এই সংসদ সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আর যাতে বাল্যবিয়ে না হয় সে জন্য ইউএনও ও চেয়ারম্যানরা সজাগ আছেন। আর কোনো বাল্যবিয়ে হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর