নদী পার হয়ে হাজার হাজার উন্মত্ত মানুষ আসছে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটির দিকে। তাদের হাতে রামদা, লাঠিসোঁটা। জীবন বাঁচাতে নারী ও শিশুসহ গ্রামের বাসিন্দারা দৌড়ে পালাচ্ছে। আশ্রয় নিয়েছে হাওরে বোরো ধানক্ষেতে। সেখানে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে, তাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর আর লুটপাটের তাণ্ডব।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের অনুসারীদের হামলার শিকার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ভুক্তভোগীরা এ বর্ণনা দিয়েছেন।
মামুনুল হককে নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে এই নোয়াগাঁও গ্রামের যুবক ঝুমন দাস আপনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ওই স্ট্যাটাসের জেরে বুধবার সকালে কাশিপুর, নাচনী, চণ্ডীপুরসহ কয়েকটি গ্রাম থেকে মামুনুল হকের অনুসারীরা নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা ও লুটপাট চালায়।
নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা সংগীতশিক্ষক দেবেন্দ্র কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি দেখছি, হাজার হাজার মানুষ ধারাইন নদী পার ওইরো। বউ, ফুয়া-ফুরিনতাই (ছেলে-মেয়ে) জান বাঁচানির লাগি হাওরে দৌড় দিছে। আমরার কিচ্চু করার আছিল না। জীবন বাঁচানির লাগি আমরা হাওরও আশ্রয় নিছি। দেখছি, আমরার ঘরও ডুখিয়া (ঢুকে) সুনাদানা, টেখা-পয়সা সব নিছেগি।’
হামলার পর ঘর ছেড়ে হাওরে আশ্রয় নেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা
ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন দেবেন্দ্র কুমার। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর ঘরে ফিরে দেখেন সব তছনছ করা হয়েছে। বলেন, ‘আমার ফুয়া কাইল (মঙ্গলবার) লোন আনছিল ৫০ হাজার টাখা। পালানির সময় ওই টাখার খতা (কথা) ভুইল্যাই গেছলাম। উটা ঘরেই রইয়্যা গেছিল। ওইটা নিয়া গেছে। তিন ভরি সোনা নিছে। চিয়ার-টেবিল ভাঙি লাইছে। আমার শখের হারমনিও ভাঙছে। আমি শ্বাসকষ্টের রুগী। এখন যে ওষুধটাও, খাইমু এই টাখাও নাই।’
হেফাজত নেতা মামুনুলের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর এই হামলার কারণ বুঝতে পারছেন না রাকেশ রঞ্জন দাশ। তারা তো কোনো দোষ করেনি। তিনি বলেন, ‘আমরা কী দোষ করছি! যে সময় হামলা করছিল দৌড়াইয়্যা হাওরে না গেলে মাইরা ফালাইতো। ধানের ক্ষেতে না লুকাইলে বাড়িঘরের মতো আমরারে কুপায়া কাইট্টালতো।’
ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আর স্ত্রীর হাত ধরে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন লিটন চন্দ্র দাশ। তিনি বলেন, ‘দেখি কি, গ্রামের মানুষ বাড়িঘর ফালাই থুই দৌড়াতাছে। আমিও আমার পরিবার (স্ত্রী) ও ছুডু বাচ্চারে নিয়া দৌড় দিছি। হাওরওত গিয়া লুকাইছি। পরে আইয়া দেখি ঘরের অবস্থা নাই। তিনটা আংটি আছিল নিয়া গেছে।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর-রাজাকারদের হানা দেয়ার কথা গুরুজনদের কাছ থেকে শুনেছেন স্বপন চন্দ্র দাস। সেই যুদ্ধদিনের মতো পরিস্থিতিতে পড়বেন কল্পনাও করেননি তিনি।
স্বপন বলেন, ‘এমন ঘটনা আমরা জীবনে আর দেখি নাই। মানুষ এমন ফাগলের মতো অয়! আমার ফুরি ক্লাস সেভেনে পড়ে। তাইরে আর জান লইয়া হাওরও লুকাইছি। হেরা গেলে গা পরে ঘরত গিয়া দেখি দলিলপত্রও নিয়া গেছে।’
শুধু গ্রামবাসীই নয়, জনপ্রতিনিধি হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুলকেও আত্মরক্ষার জন্য বাড়ি থেকে পালাতে হয়। তখন জীবন বাঁচানোই ছিল জরুরি। বলেন, ‘তারা লাঠি আর রামদা নিয়া আইছে। আমরা পরিবারের সবরে নিয়া হাওরও গিয়া লুকাইছি। জীবনটা তো আগে। কাছে পাইলে কাইট্টা টুকরা টুকরা কইর্যালতো। হামলাকারীরা আমার ঘরের জিনিসপত্র সোনাদানা লই গেছে।’
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন ঘটনায় আমরা দোষীদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি। গ্রামের যে ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের আমরা পুরোপুরি সহযোগিতা করব। প্রশাসন তাদের পাশে আছে।’