পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি এলাকাকে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। এই বনে দুর্লভ প্রজাতির বিভিন্ন গাছের পাশাপাশি বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ রয়েছে।
কিন্তু সংরক্ষিত এই বনের মধ্যে চট্টগ্রামের পটিয়া-হাইদগাঁও দিয়ে রাঙ্গুনিয়া পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে চায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এ জন্য ৩৩ লাখ ৫৯৫ টাকার একটি প্রকল্পও নেয়া হয়েছে।
তবে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অনাপত্তিতে প্রকল্পটি ঝুলে গেছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
বন বিভাগের দাবি, সড়কটি নির্মাণ করা হলে বন্য প্রাণীর এই অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সওজকে বন বিভাগ জানায়, ১৯২৭ সালের (সংশোধিত) বন আইনে বন অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ বা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ।
দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ির মধ্যে সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, সেটা ২০১০ সালে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণা করে সরকার। সেজন্য বন অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে কোনো কার্যক্রম শুরু না করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে সওজকে।
সওজের দাবি, সড়কটি করলে লাখ লাখ মানুষ সুবিধা পাবে। চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবান ও কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ উন্নত হবে। এতে করে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
সওজের উন্নয়ন প্রকল্পে বলা হয়, পটিয়া-অন্নদাদত্ত-হাইদগাঁও-রাঙ্গুনিয়া মহাসড়কটি নির্মাণ করা গেলে বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি সহজ ও নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।
এটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্প বিধায় এর আওতায় যেসব সড়ক ও সেতু নির্মাণ করা হবে, তাতে কোনো ধরনের টোল দিতে হবে না। পরিবহন পরিচালন ও ভ্রমণ ব্যয় সাশ্রয় বিবেচনায় অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হবে যাতায়াতকারীরা। প্রস্তাবিত প্রকল্পের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য।
দোহাজারী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সড়কটি পটিয়া-অন্নদাদত্ত-হাইদগাঁও-রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম খুরুশিয়া-কালিন্দিরানী সড়ক-দুধপুকুরিয়া-চন্দনাইশের ধোপাছড়ি-শঙ্খতীরের ডলুপাড়া-বালাঘাটা হয়ে বান্দরবানের সঙ্গে মিলিত হবে।
‘মহাসড়কটি নির্মাণ করা গেলে বান্দরবান-দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, রাজস্থলী, কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী এলাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করা সহজ হবে। এসব এলাকার মানুষকে এখন বান্দরবান কিংবা কক্সবাজার যেতে হলে রাউজান, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম শহর ঘুরে যাতায়াত করতে হয়।
‘বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামগামী বাস কিংবা পণ্যবাহী যান বর্তমানে সাতকানিয়ার কেরানীহাট-চন্দনাইশ হয়ে যাতায়াত করে। মহাসড়কটি নির্মাণ করা গেলে বান্দরবানের পর্যটন খাত এবং সেখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণেও আমূল পরিবর্তন আসবে।’
সুমন সিংহ বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়ার যে অংশে সড়ক নির্মাণ করা হবে সেখান থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অভয়ারণ্য এলাকা অবস্থিত। বন বিভাগের যেটুকু অংশে সড়ক হবে, সেখানে তেমন কোনো গাছপালা নেই। তা ছাড়া পাহাড় কিংবা গাছপালা না কেটেই সড়কটি নির্মাণ করা যাবে। শুধু দক্ষিণ বন বিভাগের বাধার কারণে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটি আটকে আছে।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দোহাজারী এলজিইডি থেকে পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া হয়ে বান্দরবান পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগকে।
প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী রাঙ্গুনিয়ার সংরক্ষিত দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে সড়কটির একাংশ নির্মাণ করা হবে, যা পরিবেশ, বন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। সেজন্য বন বিভাগ প্রস্তাবটিতে আপত্তি জানিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সড়কটি নির্মাণ হলে এই সংরক্ষিত বনের প্রাণীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে। সংরক্ষিত বনের মধ্যে সড়ক নির্মাণ করা হলে সড়কের দুই পাশে অবৈধ দোকানপাটসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠবে। অনুপ্রবেশকারীদের বনের মধ্যে প্রবেশ করে জবরদখলের প্রবণতাও বেড়ে যাবে। তখন সীমিত লোকবল দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। এ বনের অভ্যন্তরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ আছে, সেগুলোও তখন রক্ষা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।’
পরিবেশবাদীরাও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সড়ক নির্মাণকে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পাখির জন্য বড় ধরনের হুমকি মনে করছেন।
পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশন আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ইদ্রিছ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ির বন্যপ্রাণীরা। এসব বন্য প্রাণী এবং দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। সে জন্য এ অভয়ারণ্যে ও আশপাশেও কোনো সড়ক নির্মাণ না করার দাবি জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১০ সালে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণার পর তৎকালীন পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি একই সালের ৯ মে এ বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য উদ্বোধন করেন।
‘ইন্টিগ্রেটেড প্রটেক্টেড এরিয়া কো-ম্যানেজমেন্ট’ প্রজেক্টের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতায় এ বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুধপুকুরিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম খুরুশিয়া, পশ্চিম ধোপাছড়ি ও জঙ্গল ধোপাছড়ি মৌজার ৪ হাজার ৭১৬ একর এলাকাজুড়ে রাঙ্গুনিয়া-চন্দনাইশ উপজেলার মাঝামাঝিতে এ অভয়ারণ্যটির অবস্থান। এ অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক ছড়া, বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি, আদিবাসী পল্লী, বুনো অর্কিড, শতবর্ষী বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, নিবিড় বাঁশ বন ও ঘন বেত বাগান আছে।