কুড়িগ্রামে করোনায় সরকারের দেয়া আর্থিক প্রণোদনার একটা অংশ পকেটে ভরেছেন সরকারি কর্মকর্তাদের একটি চক্র। প্রাণিসম্পদ বিভাগের খামারিদের প্রণোদনার টাকা পেতে ঘুষ নেবার অভিযোগও উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চড়েয়ার পাড় গ্রামের বাসিন্দা সোলে বিবি গরুর খামার করার জন্য সরকারের প্রণোদনার ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তার নিজের তিনটি গরু রয়েছে। সোলে বিবির পরিবারের তিন সদস্য প্রণোদনার প্রায় ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তার ছেলে সোলায়মান মুরগির খামার দেখিয়ে ১১ হাজার ২৫০ টাকা পেলেও দেখা যায়, তার খামারে কোনো মুরগি নেই। আরেক ছেলে জাহাঙ্গীরের গরু নেই। মায়ের পালিত তিনটি গরু দেখিয়ে প্রণোদনার ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রণোদনার তালিকায় নাম তুলতে একটি চক্রকে ঘুষ দিয়েছেন তারা।
সোলে বিবি জানান, তার নিজেরই গরু রয়েছে তিনটি। ছেলের গরু কয়টি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাবা মোর দুইটা আর ছেলের একটা গরু আছে। প্রণোদনার ১০ হাজার টাকা পাইছি। তবে খরচ গেছে চার হাজার টাকা।’
সোলে বিবির ছেলে জাহাঙ্গীর বাড়িতে কোনো গরু দেখাতে না পারেননি। প্রণোদনার টাকা পাবার কথা স্বীকার করেন তিনি। গরুর আছে কি না, জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘মোর গরু মার কাছে আদি দিছি। সেখানেই থাকে।’
প্রণোদনার টাকার পেতে কাউকে ঘুষ দেননি বলে জানান তিনি।
সোলে বিবি জানান, প্রণোদনার ১০ হাজার টাকা পেতে খরচ গেছে ৪ হাজার টাকা। ছবি: নিউজবাংলা
একই এলাকায় ময়না বেগম বলেন, ‘মুই আর ছেলের বউ দুই জনে ২০ হাজার টাকা পাইছি।’ তারা জানান, তালিকায় নাম তুলতে এক হাজার এবং মোবাইল ফোনে টাকা আসার পর তিন হাজার টাকা দিয়েছেন তারা। এ টাকা তারা কাকে দিয়েছেন, সে তথ্য দিতে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন।
মর্জিনা বেগম বলেন, ‘অফিসের লোক তালিকা করার সময় তিন হাজার টাকা নিয়া তালিকায় নাম দিছে। কিছুদিন আগে গরু পালনের জন্য মোবাইলে ১০ হাজার টাকা পাইছং।’
বৃদ্ধ শমসের আলী বলেন, ‘দুইটা গরুর জন্য ১০ হাজার টাকা পাইছং। স্থানীয় দালাল কাফি ও শাহিন তিন হাজার টাকা চাইছে। মুই ওমাক ১০০ টাকা দিয়া কইছং, চা খাও। আর তিন হাজার টাকা না, মুই ওমাক কিছু দিন দুই হাজার টাকা দিবার চায়া সময় নিছং, বাহে।’
করোনায় গরু ও হাঁস-মুরগির খামারের ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের জন্য সরকারের দেয়া প্রণোদনার অর্থ পেতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের খামারিরা। এই প্রণোদনার টাকা পেতে তালিকায় নাম লেখাতে স্থানীয় দালাল চক্রসহ সংশ্লিষ্টদের দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে সুবিধাভোগীদের। যারা সিন্ডিকেট চক্রের শরণাপন্ন হননি, তাদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারের প্রণোদনার টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দা মজিবর রহমান জানান, ঘুষের বিনিময়ে সরকারি চাকরিজীবী পরিবারের সদস্যসহ সচ্ছল খামারিরা প্রণোদনা পেয়েছেন। আর যারা ঘুষ দিতে পারেননি, তাদের প্রণোদনার তালিকায় নামই ওঠেনি বলে জানান।
দালাল চক্রের একজন সদস্য আব্দুল কাফী ঘুষ নেবার অভিযোগ অস্বীকার করলেও তার পিতা-আত্মীয়-স্বজনসহ প্রায় ৪০ জন প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন বলে জানান। তিনি তালিকা প্রণয়নে কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেছেন বলে স্বীকার করেন।
প্রণোদনা পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের। ছবি: নিউজবাংলা
উলিপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল আজিজ প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাভোগীদের তথ্য দিতে রাজি হননি। বলেছেন, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা আছে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কারো লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখবেন।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, ‘উপজেলার খামারিদের তালিকা সুপারিশ করেছি। আমার কাছে সুপারিশকৃত তালিকাটি নেই উপজেলা প্রাণিসম্পদের কাছে রয়েছে। উৎকোচ নেবার বিষয়টি আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল হাই সরকার বলেন, ‘এখানে ঘুষ নেবার সুযোগ নেই। আমরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তালিকা করেছি। খামারিদের এনআইডি, মোবাইল নম্বরসহ খামারির এবং পালিত প্রাণীর ছবি অ্যাপে আপলোড করা হয়েছে। তবে কেউ যদি অভিযোগ করে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারের প্রণোদনার জন্য জেলার ৯টি উপজেলার ৩৩ হাজার ৫৪৫ খামারির তালিকা অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরির মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরকারের এককালীন এই প্রণোদনা পেতে শুরু করেছেন ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে।