চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে একটি কওমি মাদ্রাসায় আট বছর বয়সী এক শিশুকে পিটিয়ে হাড় ভেঙে দেয়ার ঘটনাতে নাম আসা দুই শিক্ষকের কোনো শাস্তি পেতে হয়নি।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে একটি কওমি মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের পর বাবা মা যেভাবে শিক্ষককে ‘মাফ’ করে দিয়েছেন, এখানেও সেই ঘটনাই ঘটেছে।
এই শিশুটির বাবা মা দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করলেও আদালতে উঠার পর তারা আসামিদের সঙ্গে মীমাংসায় চলে এসেছেন।
স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এলাকাবাসী ‘মানবিক কারণে’ দুই শিক্ষককে ক্ষমা করে দিতে ছেলেটির বাবাকে অনুরোধ করলে তিনি মামলা তুলে নেন।
মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক এই ঘটনাটিকে দুঃখজনক বললেও তারা দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। তবে দুই শিক্ষক মামলা থেকে পার পেয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
শিশুটি জীবননগরের কাশিপুর দারুল উলুম কওমি মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র।
জীবননগর থানায় করা মামলা অনুযায়ী ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর বুধবার সকাল ১০টার দিকে শিশুটি পড়া না পারায় শিক্ষক মাজেদ হোসেন তাকে মারপিট করে মাদ্রাসার একটি কক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে রাখেন।
দুপুরে নামাজ পড়ার জন্য কক্ষের তালা খুললে সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে শিক্ষক শাহিন হোসেন তাকে ধরে ফেলেন। তখনও ব্যাপক মারধর করে আবার আটকে রাখেন।
শিশুটি খেলতে গিয়ে আগেও একবার হাত ভেঙেছিল। ভালো হওয়ার পর মাদ্রাসায় মারধরের পর আবার ভেঙে যায় সে হাত।
খবর পেয়ে সন্ধ্যায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হয়।
রাতেই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন শিশুটির বাবা। আসামিদেরকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। তবে আদালতে তোলা হলে তারা জামিন পেয়ে যান।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর শিশুটির বাবা আদালতে আপোষনামা দাখিল করে জানান, তিনি আর মামলা চালাতে রাজি নন। বিচারক সে আপোষনামা গ্রহণ করে দুই শিক্ষককে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।
পিটিয়ে ছেলের হাত ভেঙে দেয়ার পরেও বাবা দুই শিক্ষককে ক্ষমা করে দেন মূলত এলাকাবাসীর অনুরোধে। তিনি জানান, স্থানীয়রা তাকে বারবার বলতে থাকেন, মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে নেয়া ভালো নয়। তাদের ভুল হলেও পরকালের কথা ভেবে যেন মাফ করে দেয়া হয়।
নিউজবাংলাকে শিশুটির বাবা বলেন, ‘শিক্ষক মানুষ ভুল করে ফেলেছেন। ভুল তো মানুষই করে। তাই এলাকাবাসীর পরামর্শে মামলার বিষয়টি আপোষ করা হয়।’
কাশিপুর দারুল উলুম কওমি মাদ্রাসার মোহতামিম মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। তিনি বলেন, ‘মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার পর শিক্ষক মাজেদ হোসেন ও শাহিন হোসেন চাকুরি ছেড়ে চলে গেছেন।’
জীবননগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মানবিকতার বিষয়টি চিন্তা করে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ওই অভিভাবককে মামলা তুলে নিতে বলেন। শিশুর বাবা মামলার বিষয়টি আপোষ করেন। পরে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়। এখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না।’
চট্টগ্রামে শিশু শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসা শিক্ষকের প্রহার। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া
সম্প্রতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি নামে একটি হাফেজি মাদ্রাসাতেও একটি শিশুকে পেটানোর ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। শিশুটির মা তাকে দেখতে এসেছিল। মা ফিরে যাওয়ার সময় ছেলেটি তার পিছু নেয়।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া শিশুটিকে ঘার ধরে টেনে নিয়ে কক্ষে ব্যাপক মারধর করেন। আর সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় ফেসবুকে।
এই ঘটনার পর স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াহিয়াকে আটক করে নিয়ে গেলেও শিশুটির বাবা মা ই তাদেরকে ছাড়িয়ে আনেন।
পরে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে বাবা-মা মাফ করে দিলেও পুলিশ মামলা করে শিক্ষক ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে। বিষয়টি গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। উচ্চ আদালত এই ঘটনায় জানতে চেয়েছে, সন্দেহভাজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
প্রায়ই কওমি মাদ্রাসায় এই ধরনের নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনা সামনে আসে। ইদানীং অভিভাবকরা সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে মামলাও করছেন। তবে ধর্মীয় আবেগের কারণে মামলা না করার ঘটনাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে।