গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় যে মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, তিনি ওই পরিবারের দ্বিতীয় পুত্রবধূ। পরিবারটির প্রথম পুত্রবধূকে তালাক দেয়া হয়েছিল সাড়ে তিন বছরে গর্ভবতী হতে না পারার কারণে।
অভিযোগ উঠেছে, দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় শ্বশুরবাড়িতে জায়গা হারানো নারীর নাম রোকসানা খাতুন। হাসপাতাল থেকে চার দিনের নবজাতকসহ ঘরে এলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে চাইলে তাদের কথাও মানেনি পরিবারটি।
এই ঘটনার খোঁজ খবর নিতে গিয়ে জানা যায় রোকসানার স্বামী রাজা মিয়া বিয়ে করেছেন আগেও। সেটি বছর পাঁচেক আগের কথা।
বিয়ের সাড়ে তিন বছরেও সন্তান হচ্ছিল না স্ত্রী সুরভী বেগমের। আর এই কারণ দেখিয়ে ২০১৯ সালে তাকে তালাক দেন রাজা মিয়া।
- আরও পড়ুন: মেয়ে জন্ম দেয়ায় ঘর থেকে বিতাড়িত মা
তালাকের পর নির্যাতন, যৌতুক দাবির অভিযোগ ও দেনমোহর চেয়ে রাজা মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেন সুরভী। এরপর কয়েক দফায় ভেঙে ভেঙে দেনমোহরের একাংশ পরিশোধও করেন রাজা মিয়া। কিন্তু গত ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পূর্ণ মোহরানা পরিশোধের কথা থাকলেও তিনি তা দেননি। আর এ কারণে তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
এরপর থেকে রাজা মিয়া রয়েছেন পলাতক।
রাজা মিয়ার বাড়ি উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘোমামারা গ্রামে। বৃহস্পতিবার তার দ্বিতীয় স্ত্রী কন্যা সন্তানসহ বাড়ি ফিরলে শ্বশুর শাশুড়ি ঘরে ঢুকতে দেননি তাকে। উপায়ান্ত না দেখে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দেন রোকসানা। ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। কিন্তু তাকে বাড়িতে তুলে দিতে ব্যর্থ হয় তারা। এরপর বাবার বাড়িতে যেতে বাধ্য হয়েছেন রোকসানা।
এই বাড়ি থেকেই গৃহবধূ রোকসানাকে কন্যাসন্তানসহ বের করে দেয়া হয়। ছবি: নিউজবাংলা
রোকসানা খাতুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগের বউটাকে খুব মারপিট করত ও (রাজা মিয়া)। যৌতুক চাইত। পরে ছোল না হওয়ায় মেয়েটাক তালাক দেয়। মেয়েটাও পরে মামলা করে।’
‘গত মাসের ২২ তারিখ টাকা সব দিতে বলে আদালত। কিন্তু ও টাকা ম্যানেজ করতে পারে নাই। পরে শুনি ওকে পুলিশ ধরবে।’
‘এগলে আগে জানলে ওকে বিয়ে করতাম না’- এমন আফসোস করে রোকসানা বলেন, ‘ও (রাজা মিয়া) খুব খারাপ। আমাকে ভাত ছাড়া কিচ্ছু দেয়নি। না দিছে সখের কোন জিনিস, না দিছে ভালোবাসা। আমি ওর শাস্তি চাই।
‘এক বছর আগে আমার বিয়ে হচে। বিয়ের কিছুদিন আমার বর আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। তারপর যখন বেবি কনসেপ করছে; ওরা যখন বেবি টেস্ট করছে, তখন জানছে মেয়ে বাবু। এখন বলে মেয়ে নাকি ওদের না।’
বাড়ি ফেরার পর রোকসানাকে জানানো হয়, সুরভীর মতো তাকেও তালাক দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ফুফুর সাথে রংপুর হাসপাতালে যেতে বলছে ও। চারদিন পর বাবু নিয়ে বাড়িত আসছি; বাড়ির মধ্যে আর উঠতে দেয় না। বলে যে, আমরা তোমাক ডিভোর্স দিয়ে দিছি।’
রোকসানার মা ফাতেমা বেগম বলেন, ‘দামান (জামাই) আগের বউক কিল-ডান (মারধর) করছে। মোর মেয়েটাকও মারছে.. বাবা। মোর বেটির কী দোষ; নাতনী হচে যে।’
তিনি বলেন, ‘চারদিন আগত অমপুরত (রংপুর) গেছি। সেটি মেয়ে বাচ্চা হচে। নাতনীক নিয়ে তামার বাড়িত গেছি; ওমনি আর ঘরত উঠপের দেয় না হামার বেটিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘অমপুরত হাসপাতালত ছোল হতে ২০ হাজার টেকা খরচ হচে। একটা টেকাও ওমরা দেয় নাই। হামরা গরিব মানুষ। হাওলাত-বাওলাদ করি টেকা দিছি।’
এ বিষয়ে রাজা মিয়ার প্রথম স্ত্রী সুরভী বেগমের বড় ভাই সরপরাজ মহুড়ি বলেন, ‘অপবাদে বোনটাক ছাড়ছে রাজা। এই দুঃখে আমার বোনটা এখনও কোথায় বিয়ে করেনি। ওর (রাজা মিয়া) ভালো হবে না। ওর বিচার আল্লাহ করবে।’
রোকসানাকে সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার খবরে দুঃখ পেয়েছেন সরপরাজ। বলেন, ‘ছেলেটা আসলেই বেয়াদব। আজকে শুনছি এই মেয়েটাক বাড়ি থেকে বের করে দিছে। এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার কী হবে?’
এসব বিষয়ে জানতে রাজু মিয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরে রোকসানার শ্বশুরের মোবাইল ফোন করলে তার স্ত্রী আছমা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ির বউয়ের কাছে ঘনঘন বন্ধু আসে। বউয়ের চরিত্র খারাপ। তাই তাকে তিন মাস আগে তালাক দিছে আমার ছেলে।’
তিনি বলেন, ‘আগের বউটাও খারাপ। দুলাভাইয়ের সাথে উল্টা-পাল্টা সম্পর্ক। ছোলও হবে না তার কোনোদিন। তাক দিয়ে কী হবে।’
ছেলের বউ রোকসানাকে তিন মাস আগে তালাক দেয়া হলে বিয়ের পর থেকে গত ৮ মার্চ পর্যন্ত কীভাবে আপনার বাড়িতে অবস্থান করল। এমন প্রশ্নের জবাবে আছমা বেগম বলেন, ‘কিছু বলি নাই; পেটে বাচ্চা জন্যে। যদি কোন কিছু করে বসে। গলায় ফাঁস দেয়।’
গর্ভবতী অবস্থায় তালাক আইনে নিষেধ ও তালাকের কাগজ দেখতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তালাকের কাগজপত্র বাড়ির গাজ্জিয়ান কবার পাবে। বেটিছল মানুষ কী ওগলে বুঝি। সব তারা (স্বামী-ছেলে) জানে।’
সাদুল্লাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ রানা জানান, জরুরি সেবার ফোন পেয়ে গতকালেই নবজাতকসহ রোকসানাকে উদ্ধার করে তার বাবার বাড়িতে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনো কোন লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘রাজা মিয়ার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে থাকতে পারে। পরোয়ানা জারি থাকলে তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।’