গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় একটি হত্যা মামলার আসামিদের বাড়িঘরে বাদীপক্ষের লোকজন হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার এড়াতে পুরুষরা বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। এ কারণে আসামিপক্ষের নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। রাতে ভুট্টাক্ষেতে ও কলাবাগানে আশ্রয় নিচ্ছেন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তেলকুপি গ্রামের বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে যাওয়ার পথে উড়িয়ার সাদেকখাঁ বাজার এলাকায় প্রতিপক্ষ এনায়েত হোসেন ও তার লোকজন লাল মিয়াকে ছুরিকাঘাত করেন। পরে রংপুর মেডিক্যালে লাল মিয়া মারা যান।
এ ঘটনায় পরদিন ফুলছড়ি থানায় হত্যা মামলা হয়। এতে চরের ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২০/২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে পরদিন থেকে কাবিলপুর চর পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে।
গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, লাল মিয়া ডাকাত ছিলেন। তার তিন স্ত্রী। সাত মেয়ে ও ১১ ছেলে রয়েছে। এই ছেলেরাই এখন চরের বাসিন্দাদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন।
চর কাবিলপুর ছাড়াও পার্শবর্তী চরে জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে ফুলছড়ি থানায় নিহত লাল মিয়া ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে।
বাদী পক্ষের লোকজনের ভাঙচুর। ছবি: নিউজবাংলালাল মিয়া হত্যা মামলার আসামি তৈয়বুর রহমান, স্থানীয় ইউপি সদস্য এনায়েত আলী এবং চরের বাসিন্দা হাকিম, রেজাউল, হাসেম, হারুন, হামিদ, হালিম ও রিপনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বাড়িঘরে তার ছেলেরা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব পরিবারের শতাধিক গবাদি পশুও লুট করে নিয়ে গেছে।
দিনদুপুরে ওরা ১১ ভাই ও তাদের স্বজনরা অস্ত্র উঁচিয়ে চরে মহড়া দেন বলেও অভিযোগ আছে।
ইউপি সদস্য এনায়েত আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, দুটি শোয়ার ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। বিছানাপত্র, বইখাতা মেঝেতে পড়ে আছে। গোলাঘর ধান-চাল শূন্য।
এনায়েত আলীর স্ত্রী রেজিয়া বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গরু-বাছুর, ধান-চাল, টাকা-পয়সা যা আছিল, সব নিয়া গেছে। অহন কিচ্ছু নাই। একটা কাপড় ফেলা থুয়ে গেছে। তাই পিনদিছি। ওরা আগের থেইকায় সন্ত্রাস। ওগোর ব্যবসাই ওইডা। লাল মিয়া আছিল ডাকাত-ভূমিদস্যু। ধান-চাল কাটি নেয়। নারী নির্যাতন করে। আত্রে কেউ বাইরে প্রস্রাব করতে হারে না। ঘরে করা লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এগলে কথা পুলিশক কলি পড়ে আমদাও (রামদা) নিয়ে আসে লাল মিয়ার বেটারা। জানের তো ভয় আছে। ভয়ে ওরা (পুরুষরা) দেওয়ানগঞ্জ চলি গেছে। আসেই নাই। ওমরা নিজের ঘর ভাঙ্গি মামলা দেয় হামার সোয়ামিদের নামে। রাতে ভুট্টার ক্ষেতে কেবা করে থাকি বাবা; মশা-সাপের ভয়। ওদের ভয়ে তবুও থাকি বেটি-বউ নিয়ে।’
পাশের বাড়ির তৈয়বুরের বাড়ি-ঘরের ভাঙচুরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পরের বাড়ি আজিজ মিয়ার। তার ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। গোলায় কোনো ধান-চাল নেই। প্রতিবেশী মিজানুর ও আনিসের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লুট হয়েছে সব মালামাল। এছাড়া এনায়েত আলীর সাত ছেলে, হাকিম, রেজাউল, হাসেম, হারুন, হামিদ, হালিম ও রিপনের বাড়িঘর লুটপাট ও ভাঙচুর হয়েছে। সাত ভাইয়ের ৪০টি গরু লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তৈয়বুরের স্ত্রী এলিজা বেগম বলেন, ‘সব শেষ বাবা। ডাকাত লাল মিয়ার বেটারা হামার সব নিছে। রামদা নিয়ে কোপাতে আসে। বাজারের দোকান খুলতি দেয় না। কথা কলি রামদা-লাঠি নিয়ে মারতে আসে। আমাদের ঘরে কোনো খাবার নেই।’
একই চরের মোবারক খাঁর বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট হওয়ার পর তারাও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। মেয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ইউপি সদস্য এনায়েতের বাড়ির পাশে। সেখানে অন্য নারীদের সঙ্গে রাতে ভুট্টাক্ষেতে রাতে আত্মগোপন করেন।
মোবারকের মেয়ে বলেন, ‘যায়-জিনিস, টেকা-পয়সা সব নিয়ে গেছে তারা (লাল মিয়ার ছেলেরা)। আমার বাবা-মা কেউ বাড়িত নাই। সব পলাইছে। শুধু পেন্দনের কাপড়া থুয়ে গেছে। এই মামলার আসামি না হলেও তারা ঘর লুট করেছে।’
উকিয়া বেগম, জরিনা বেগম, চায়না বেগম জানান, বাজারের বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। লুট করা হয়েছে সব মালামাল। কারও ঘরে চাল পর্যন্ত রাখেনি তারা। এমনকি আশপাশের সব জমিতে সেচ পাম্প বন্ধ রেখেছে লাল মিয়ার ছেলেরা। জমিতে পানি পর্যন্ত নিতে দিচ্ছে না।’
গ্রেপ্তার আতঙ্কে স্থানীয় বাজার এক মাস ধরে বন্ধ। ছবি: নিউজবাংলাস্থানীয় আনন্দলোক স্কুলের টিম লিডার হাজেরা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, ‘গত এক মাসে ওপারে যেতে পারিনি আমরা। মসজিদে আজান দিতে দেয় না। আমরা রাতে বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারি না। স্কুল খুলতে দেয় না। তারা একাত্তরকেও হার মানিয়েছে। তারা ডাকাত। তাদের বিচার হয় না। উল্টো আমাদের বাপ-স্বামীরা ঘর ছাড়া।’
এদিকে গত ১ মার্চ কাবিলপুর চরের মিজানুর ও আনিচের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু প্রতিবেশীরা বলছেন, ঘরে আগুন জ্বালিয়ে অন্যান্য ঘর থেকে সব লুটে নিয়েছে ১১ ভাই।
অথচ গত ৫ মার্চ এই চরের ২৭ জনের বিরুদ্ধে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের মামলা করেন নিহত লাল মিয়ার ছেলে মুরশিদ আলী। একই দিন লাল মিয়ার বেয়াই আবুল বাশার চৌধুরী তার ছেলের বউকে মারধরের অভিযোগ এনে ফুলছড়ি থানায় আরেকটি মামলা করেন।
মামলার বাদী পক্ষের লোকজন এক ব্যক্তির বাড়িতে আগুন দেন বলে অভিযোগ। ছবি: নিউজবাংলাআসামিদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন লাল মিয়ার হত্যা মামলার বাদী তার ছেলে মুরশিদ আলী। তিনি বলেন, ‘তারা মাডার করছে। এ জন্য ঘরছাড়া। তারা নিজেদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে আমাদের দোষ দিচ্ছে। বাজারের সব দোকানদার হত্যা মামলার আসামি। তারা দোকান তালা দিয়া ভাগছে। এমনকি মসজিদের ইমামও আসামি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। কিন্তু তারা এখন আমাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করছে। লোকজনদের মারপিট করছে। আমি এসবের বিচার চাই।’
এ বিষয়ে ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাওছার আলী বলেন, এই হত্যা মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। দুজন আসামিও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে।
তিনি বলেন, ‘কাবিলপুর বাজারের অধিকাংশ দোকানদার আসামি হওয়ায় পলাতক রয়েছেন। মসজিদে মুসল্লি যাতায়াত নিশ্চিতসহ বাজার চালুর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই সাথে চরের স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য কাজ করছে পুলিশ।’
ওসি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের বিচার আইন অনুযায়ী হবে। তবে এটাকে পুঁজি করে নতুন করে সহিংসতা হতে দেয়া হবে না।