কাপ্তাই লেকের মাছের প্রধান চারটি প্রজননস্থলের (চ্যানেল) মধ্যে দুইটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে এখন কার্পজাতীয় মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। পলি মাটি জমার পাশাপাশি পানির স্থায়িত্ব কমে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রজননস্থলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৮ সালে কাপ্তাই লেকের জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবুল বাশার। তার গবেষণায়ও চারটি চ্যানেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রজননস্থলগুলো হচ্ছে চেঙ্গী চ্যানেল ও রীংকং চ্যানেল।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) রাঙ্গামাটি নদী-উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিএম শাহিনুর রহমান বলেন, চেঙ্গী চ্যানেল ও রীংকং চ্যানেল পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে, চ্যানেল দুইটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। কাসালং চ্যানেল ও বরকল চ্যানেলও নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টি কম হচ্ছে। আগে পাহাড়ে এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টি হতো। টানা ৬ থেকে ৭ মাস বৃষ্টি হলে লেকে পর্যাপ্ত পানি থাকত। এখন আগের মতো বৃষ্টি হচ্ছে না। লেকে পর্যাপ্ত পানি হচ্ছে না। ফলে লেকে পানির স্থায়িত্ব কমে গেছে। প্রজননস্থলগুলো নষ্ট হওয়ার এটিও একটি কারণ।
বিএম শাহিনুর রহমান বলেন, কাপ্তাই লেকের পাড়ে পাহাড় রয়েছে। জুম পদ্ধতিতে চাষের জন্য এসব পাহাড় থেকে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। তাতে করে ভূমিধস হচ্ছে। প্রতিবছর পাহাড়ের মাটি ধসে লেকে পড়ছে। আর পলি মাটিতেই প্রজননস্থলগুলো ভরে যাচ্ছে, তাতে নষ্ট হচ্ছে সেগুলো।
দেড় যুগের ব্যবধানে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমেছে ৮০ শতাংশ
প্রজননস্থলগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কাপ্তাই লেক থেকে কার্পজাতীয় মাছের আহরণ কমে যাচ্ছে। বিএফআরআই থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ অর্থবছরে কাপ্তাই লেক থেকে ২৫৮ দশমিক ৭৫ টন কার্পজাতীয় মাছ আহরণ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাত্র ৫৩ দশমিক ২ টন কার্পজাতীয় মাছ আহরণ করা হয়েছে। ১৮ বছরের ব্যবধানে লেক থেকে কার্পজাতীয় মাছের আহরণ কমেছে ৮০ শতাংশ।
বিএফআরআইর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবুল বাশার বলেন, আমরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে এই তথ্য তুলে ধরেছি। পলি জমে লেকের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ কমে গেছে। পানি প্রবাহ না থাকলে কার্পজাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে না। তাই আগের মতো মাছের প্রজনন হচ্ছে না। প্রজননস্থল নষ্ট, হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় গভীর জলাশয়ের অভাবে মাছ বড় হতে পারছে না। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে হ্রদে পোনা ছাড়লেও পানিস্বল্পতার কারণে জেলেদের কেচকি জালে কার্পজাতীয় মাছের পোনা ধরা পড়ে যায়।
তিনি বলেন, শুধু কার্পজাতীয় মাছ নয়, প্রজননস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে অন্য বেশ কিছু মাছও কমে যাচ্ছে লেক থেকে। ইতিমধ্যে লেক থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সিলন, দেশি সরপুঁটি, বাগাড়, মোহিনী বাটা ও দেশি পাঙাশ মাছ। আর বিপন্নপ্রায় মাছের মধ্যে রয়েছে দেশি মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, গুলশা ও সাদা ঘনিয়া। এ ছাড়া ক্রমহ্রাসমান মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, বাচা, পাবদা ও বড় চিতল।
লেকের পাড়ে জুম চাষে নিরুৎসাহিত করছে সরকার
রাঙ্গামাটির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জিএম মোহাম্মদ কবির বলেন, পাহাড়ের ঢালে বন উজাড় করে ও তা আগুনে পুড়িয়ে জমি চাষের উপযোগী করার মাধ্যমে যে চাষাবাদ করা হয় তারই নাম জুম চাষ। লেকের পাশের পাহাড়গুলো খাড়া। গাছের শেকড় পাহাড়গুলোর মাটি ধরে রাখে। কিন্তু জুম পদ্ধততি চাষের জন্য পাহাড়ের বন উজাড় বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
তিনি বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মাটি বালুর মতো যা বৃষ্টির পানির সঙ্গে সহজেই দুর্বল হয়ে ধসে পড়ে। বর্ষা মৌসুমের প্রথম কয়েক দিনের বৃষ্টিতে মাটিগুলো নরম হয়ে যায়, পরবর্তী সময়ে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করে পাহাড়ের অভ্যন্তরে চাপ ও ওজন বৃদ্ধি করে পরবর্তী সময়ে ধসে পড়ে। তখন সরাসরি মাটি লেকে পড়ে ভরাট হয়ে যায়।
জিএম মোহাম্মদ কবির বলেন, জুম নিয়ন্ত্রণে আমরা সচেনতা ক্যাম্পেইন চালাচ্ছি। লেকের পাড়ে জুম পদ্ধতিতে চাষ না করার জন্য নিরুৎসাহিত করছি। ইতিমধ্যে আমরা ফলাফল পেয়েছি। লেকের পাড়ে জুম চাষ কমে আসছে।
কাপ্তাই লেকের জীববৈচিত্র্য নিয়ে বিএফআরআইর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবুল বাশারের গবেষণায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে পোনা ও মা মাছ নিধনও কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। গবেষণায় কার্পজাতীয় মাছের হার বাড়াতে লেকের তলদেশ খনন, প্রজননস্থলগুলো পুনরায় খননের মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং এগুলোকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করার সুপারিশ করা হয়েছে।