সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নে সতীর হাওর এলাকার অনেকটা জুড়ে বছর দশেক আগেও ছিল মুর্তা বাগান। নিজেদের এই জমিতে মুর্তা চাষ করছিল বন বিভাগ। এখন সেখানে শীতলপাটি তৈরির প্রধান এই কাঁচামালের কোনো অস্তিত্ব নেই; সবই ধানি জমি। বন বিভাগের জমি দখল করে ধান চাষ করেন স্থানীয় আকরাম আলীর ছেলে ইউসুফ আলী।
শুধু তার দখলেই রয়েছে বন বিভাগের ৫০ একর জমি। দীর্ঘদিন ধরে সতীর হাওর এলাকার বন বিভাগের জমি দখল করে ভোগ করছেন তিনি। সর্বশেষ ২০০৮-০৯ সালে ৮০ হেক্টরের মুর্তা বাগান ধ্বংস করে জমি দখলে নেন ইউসুফ।
ইউসুফ আলী বন বিভাগের জমি দখলে থাকার কথা স্বীকার করলেও তার পরিমাণ এত বেশি নয় বলে দাবি করছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কিছু জমি পতিত অবস্থায় ছিল। জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল। আমরা তা সাফসুতরো করে ধান চাষ করি।’
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বনের জমি দখলে রাখতে ইউসুফ আলী নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন। জমি উদ্ধারে গেলেই বাহিনী নিয়ে হামলা চালান তিনি।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সিলেটে বন বিভাগের জমি নিয়ে হরিলুট দশা। ইউসুফ আলীসহ সিলেটের ১০ জন দখলে রেখেছেন অন্তত ৩২৫ একর জমি।
তাদের মধ্যে ছয় জনই গোয়াইনঘাট উপজেলার; বাকিরা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার।
দীর্ঘদিন জমি দখল করে রাখলেও তাদের উচ্ছেদ করতে পারছে না বন বিভাগ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জমি দখল করে স্থাপনাও করেছেন।
বন বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উদ্যোগে গত ডিসেম্বর সিলেটের শীর্ষ ১০ দখলদারের একটি তালিকা করা হয়। বন বিভাগের মাঠকর্মীদের সহায়তায় এ তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
তালিকা অনুসারে ৫০ একর জমি দখলে রেখে সবার শীর্ষে রয়েছেন গোয়াইনঘাটের ইউসুফ আলী।
কোম্পানীগঞ্জের দীঘলবাক পাড়ের নরেশ বিশ্বাসের ছেলে কল্যাণ বিশ্বাস ৪৫ একর, গোয়াইনঘাটের সতীর হাওর এলাকার চেরাগ আলী ৪০ একর, দীঘলবাকের পাড় গ্রামের ঠাকুরমনির ছেলে জবেশ ৩২ একর, রাতারগুল এলাকার এদিবদি গ্রামের আব্দুল হামিদ ৩০ একর, শিমুল বিল হাওরের সাকিবুল্লার ছেলে শামসুল ইসলাম ৩০ একর জমি দখল করে রেখেছেন।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জের ছেদারগাও গ্রামের হাজী মকদার আলীর ছেলে তোফায়েল ২৬ একর, কালীবাড়ি এলাকার মাসুদ চৌধুরীর ছেলে মাহবুবুর রহমান জীবন ২৫ একর, গোয়াইনঘাটের বদিগাই হাওরের খাদিম আলীর ছেলে শুকুর আলী ২৫ একর এবং কোম্পানীগঞ্জের কালীবাড়ির হাজী আকরম উল্লাহর ছেলে সৈয়দুর রহমান ২২ একর জমি দখল করেছেন। সিলেটে এই ১০ জনের দখলেই বন বিভাগের সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে।
সৈয়দুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ির পাশের কিছু জমি দীর্ঘদিন ধরে পতিত ছিল। আমরা সেই জমিতে চাষবাস করি। বনের কেউ এসে কোনোদিন এই জমির মালিকানা দাবি করেনি। আমরা কোনো জমি জোর করে দখল করে রাখিনি।’সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এসব দখলদারের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরে জমি দখল করে রেখেছেন। উচ্ছেদ করলেও তারা আবার দখল করে নেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জের ৪৫ একর জমি দখল করে রেখেছেন কল্যাণ বিশ্বাস। সেখানে বেশ কিছু স্থাপনাও তৈরি করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ প্রস্তাব জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছে বন বিভাগ। একাধিক মামলাও করা হয়েছে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কল্যাণ বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বন বিভাগের পতিত জমিতে এলাকার অনেক লোকজনই কৃষিকাজ ও মৎস্য চাষ করে। যাদের নিজেদের জমি নেই তারা বনের জমিতে চাষাবাদ করে। তবে কেউই জমি দখল করেনি।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, সিলেটে বন বিভাগের প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৪ একর জমির মধ্যে ৫৮ হাজার একরই বেদখলে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেদখল হয়েছে গোয়াইনঘাটে। এ উপজেলায় বন বিভাগের ২২ হাজার ২০৭ একর জমির মধ্যে ২০ হাজার ১৭৪ একর জমিই এখন বেদখলে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বনের জমি উদ্ধারে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমরা এরই মধ্যে বনের জমির শীর্ষ দখলদারদের তালিকা করেছি।
‘এদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে ১৭০০ একর জমি উদ্ধারের পরিকল্পনা রয়েছে। ৫ বছরের মধ্যে বেদখল সব জমিই উদ্ধার করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘জমি উদ্ধার করে বনায়ন না করলে দখল ধরে রাখা যায় না। তাই জমি উদ্ধারের পরপরই বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছি।’