সিলেটে প্রচন্ড শীত পড়েছে। হাঁড় কাঁপানো অবস্থা যাকে বলে। মোটরসাইকেল চালালে শীত আরও বেশি মনে হয়। একেবারে বুকে এসে বাতাসের ধাক্কা লাগে। তার ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়ে কুয়াশা। হাতের সমান দূরত্বও স্পষ্ট দেখা যায় না।
দুপুর পর্যন্ত ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ঘিরে রাখে চারপাশ। কুয়াশায় হেলমেটের গ্লাস অন্ধকার হয়ে যায়। আবার গ্লাস খুলে রাখলে কুয়াশার ফোঁটা এসে চোখে পড়ে। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা মোটরসাইকেল চালকদের।এমন অবস্থায় কয়েক স্তরের শীতপোশাক গায়ে জড়িয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে সোমবার রাতে পৌঁছা গেল সিলেট নগরের কাছে মালনীছড়া চা বাগানে। গাছ-গাছালিতে ভরপুর থাকায় চা বাগান এলাকা এমনিতেই সবসময় শীতল থাকে। এখানে শীত নামে আরও তীব্র হয়ে, আরও দুর্ভোগ নিয়ে।
সিলেটে কুয়াশাচ্ছন্ন মহাসড়কে দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে গাড়িগুলোকে। ছবি: এম এ হামিদ/ নিউজবাংলা
চা বাগানের শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন। মানব উন্নয়নের সব সূচকেই পিছিয়ে তারা। যে টাকা মজুরি পান তা দিয়ে থাকা-খাওয়ার জোগানই ভালো করে হয় না। সেখানে ভালো শীতের পোশাক কেনার টাকা কোথায় পাবেন। শীত তাদের কাছে তাই দুর্ভোগের নাম।
মালনীছড়া চা বাগানে ঢুকতেই দেখা মিলে একদল নারী-পুরুষের। গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছেন তারা। সেখানে কথা হয় নমিতা গোয়ালার সঙ্গে। তিনি জানান, ঠান্ডার কারণে ঘরেও থাকতে পারছেন না। হাত-পা মনে হয় কেটে যাচ্ছে। তাই আগুন পোহাতে বাইরে এসেছেন।
এখানে আগুন পোহাচ্ছিলেন এই বাগানেরই শ্রমিক অনিল বুণার্জি। তিনি আক্ষেপ করে নিজেদের মতো করে টেনে টেনে বলেন, ‘আমরা কুলি মানুষ। আমাদের খোঁজ তো কেউ রাখে না। শীতে আমরা বাঁচমু কেমনে?’এই বাগানের কারখানা সড়ক দিয়ে ঢুকতেই দেখা হয় বৃদ্ধ রতন পালের সঙ্গে। পাতলা একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে হাঁটছিলেন। শীত কেমন লাগছে জানতে চাইলে বলেন, ‘শীতের কথা তো আর কইয়া লাভ নাই। বেশেবা (ব্যাপক) ঠান্ডা পড়ছে। শীত কমাইতে তাই একটু খাইয়া আসলাম।’‘খাইয়া আসলাম’ বলতে বাংলা মদ খেয়ে আসার কথা বোঝালেন রতন। এরপর হেলেদুলে রওনা দেন বাগানের ভেতর দিয়ে। শীতে নাকি বাংলা মদের প্রভাবে রতনের এই দোল খাওয়া, তা ঠিক ঠাওর করা যায় না।
শীতের এই দৃশ্য সারা দেশের হলেও দুর্ভোগ যেন চা বাগানেই নামে বেশি। ছবি: নিউজবাংলা
মালনীছড়া চা বাগানের পাশেই লাক্কাতুরা চা বাগান। এই বাগানের গলফ ক্লাব এলাকায় দেখা যায় কিছু তরুণ বসে গল্প করছেন।
এদের একজন শীতল মোদী বলেন, এবার শীত একটু বেশি পড়ছে। গত কয়েক বছরে এত বেশি শীত ছিল না। তীব্র শীত আর কুয়াশার কারণে সকালে এখন বেশিরভাগ শ্রমিকই কাজ যোগ দিতে পারে না।আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, সোমবার সিলেটে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সবচেয়ে বড় চা বাগান অধ্যুষিত এলাকা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সোমবার তাপমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিল সোমবার রেকর্ড করা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, শীতের তীব্রতা চলতি সপ্তাহজুড়ে অব্যাহত থাকবে। তাপমাত্রা আরও কমতে পারে।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, চা বাগানের শ্রমিকরা সবচেয়ে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা বেশি দুর্ভোগ পোহান। এবারের তীব্র শীতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
কিছু স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে শ্রমিকদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানান তিনি।চা বাগানের শিশুদের নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষা। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক নিগার সাদিয়া বলেন, ‘প্রতি বছরই আমি কিছু শীতবস্ত্র চা বাগানগুলোতে বিতরণ করি।’নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘যেসব শ্রমিক বাইরে কাজে যেতে পারেন তারা কিছু শীতবস্ত্র পেলেও তাদের ঘরের বৃদ্ধ এবং শিশুরা বঞ্চিত থেকে যান। ফলে শীতে এরা সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েন।’