তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় গত এক সপ্তাহ ধরে বিপর্যস্ত নওগাঁর জনজীবন। সেই সঙ্গে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহে জবুথুবু প্রকৃতি। এর পরও পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ।
শহরের দয়ালের মোড়ের অটোরিকশা চালক আব্দুর রহিম। থাকেন শহরের এক টিনের ছাউনি দেয়া ঘরে। চার সদস্যের পরিবারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। শীত বা গরম কোনো মৌসুমেই বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই তার। পেটের জন্য ভোরে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে রিকশা চালান তিনি। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশা দমিয়ে রাখতে পারেনি ৬০ বছরের এই বৃদ্ধকে।
সোমবার সন্ধ্যায় শহরের উকিলপাড়ার কলেজ রোডে এক যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নিতে দেখা যায় আব্দুর রহিমকে। এ সময় তার হাত ও শরীর কাঁপছিল। অসুবিধা হচ্ছিল ভাড়ার টাকা গুনে নিতে।
এ দৃশ্য দেখার পর আব্দুর রহিমকে নিয়ে পাশের একটি চায়ের দোকানে যান এই প্রতিনিধি। কিছুটা আরাম বোধ করার পর নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এবার লওগাঁত ম্যালা শিতত্বী পরিছে বাপো। শিতত্বীর জন্নি তিনডা পুরানা মোটা কাপড় পরা থ্যাকাও শিতত্বী কাটিচ্চেনা। এতই শীত লাগিচ্চে যে মনে হয় হিমালয়ের দেশোত বাস করিচ্চি।’
এই বয়সে তীব্র শীতের মধ্যে কেন রিকশা চালান জানতে চাইলে আব্দুর রহিম বলেন, ‘কী আর করমু বাপো পেটের দায়ে রিকশা চালান ল্যাগে। যদি কাম না করি তয় চুলাত যে আগুন জ্বলবে না। হামরা গরীব মানুষ। হ্যামাকে কপালে কী শীত আর কী গরম। এগলা দেখলে চলবে না কামোত তো বাড়ানই লাগবো।’
পরিবারে আর কে কে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যামার স্ত্রী আর দুই বেটা ছোল আছে। দুই ছোল মানষের লতুন বাড়ি (পাকা বিল্ডিং) বানানার শ্রমিকের কাম করে।’
দুই ছেলে থাকতেও কেন এত কষ্ট করেন জানতে চাইলে আব্দুর রহিম বলেন, ‘দুই ছোলের লতুন বাড়ি বানানার কাম তো সব সময়োত হয় না বাপো। তাছাড়া তারকেও ম্যালা হাত খরচ হয়। তাই বেশি কিচু তারকোক কই না। ছলপোল বড় হচো।
‘একন কোনো কতা কমু আবার তারা রাগা গেলে কী কবে না কবে তাই চুপচাপই থাকি। তারকে কতা আর বেশি কিচু কবার চাইনা হ্যামি।’
নিজের জমিজমা বা বাড়ি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘বাপো চায়ের সাতে এ্যানা একটা বিস্কুট খামু।’
এর পর চা-বিস্কুট খেতে খেতে তিনি বলেন, ‘লিজের জায়াগা বলতে হ্যামার দুডা ঝুপড়ি টিন দিয়া ঘর আচে। এক ঘরোত হামি আর হ্যামার বউ থ্যাকি। আরেক ঘরোত হ্যামার দুই বেটা ছোল থাকে।
‘কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। কিন্তু রিকশা চালা যে ট্যাকা পাই সেডা দিয়াই পেট চলে। যেদিন কামোত বাড় হমুনা সেদিন যে না খাইয়া থ্যাকা লাগবে। তাই পেটের দায়ে যতই কষ্ট হোক রিকশা যে চালান লাগে।’
সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা থেকে কোনো শীতের কাপড় পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কে দিকে হ্যামার এল্লা, একন পর্যন্ত হ্যামাক কেউ গরম কাপড় দেয়নি বাপো। এ্যানা কেই যদি দিলোনি তয় খুবই ভালো হলোনি। ট্যাকা দিয়া শিতত্বীর কাপড় যে কিনার মতো হ্যামার সাদ্ধ নাই। শুনিছি ম্যালা মানষোক শিতত্বীর কাপড় দেয়। কিন্তু হ্যামি একনও পাইনিকো।’
নওগাঁর বদলগাছী আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস সোমবার জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে সাত দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে হঠাৎ ঘনকুয়াশায় ঢাকা রয়েছে নওগাঁ ও আশেপাশের অঞ্চল।
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগ বাড়ছে ছিন্নমূল ও দিনমজুর মানুষের। তীব্র শীতের জন্য লোকজন কাজ করতে পারছেন না ঠিকমতো। সকাল হলে কাজে বের হওয়ার পরিবর্তে খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছে না।