জামালপুরে ভ্যান চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা শিশু তাহাজ্জুত শম্পা ফিরেছে পড়ালেখায়। ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাবা ফিরেছেন বাড়িতে। সরকারের দেয়া টাকায় দিয়েছেন একটি মুদির দোকান। তার আশা চলতি বছরেই আবার সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
শম্পার ভ্যানটি আর চলে না। তবে সেটি বিক্রি করছে না পরিবার। সাজিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে।
জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের নাকাটি গ্রামের শম্পা এলাকায় এক পরিচিত মুখ। নাকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘তারকা’ ছাত্রী সে।
করোনাভাইরাস চলাকালে চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষা দিতে হয়নি। সরাসরি উঠেছে পঞ্চম শ্রেণিতে। নতুন বই নিয়ে এসেছে। সামনে স্কুলে যাবে; তার প্রস্তুতি চলছে।
প্রধানমন্ত্রী যে ঘর করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, সেটির কাজ শেষ প্রায়। আর অল্প কিছুদিন পরই সেখানে উঠবে শম্পার পরিবার।
নতুন ঘরের সামনে সাজানো শম্পার সেই ভ্যানটি। ছবি: নিউজবাংলাভ্যান চালিয়ে আয় করা টাকা আর সংসারে খরচ করতে হয়নি। সেই টাকায় নতুন ঘরের জন্য আসবাব কিনেছে সে।
মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িতে গিয়ে শম্পাকে দেখা গেল নতুন কেনা সেই আসবাবগুলো মুছে চকচক করে তুলছে। ঘরে নতুন বইগুলো গুছিয়ে রাখা।
পড়ালেখা কেমন চলছে জিজ্ঞাসা করা হলে শম্পা বলে, ‘ইশকুল বন্ধ; দুইটা প্রাইভেট পড়তাছি।’
এতটুকু জীবনে কতকিছুই না দেখল মেয়েটি। এই বয়সে কেউ দুঃখের স্মৃতিচারণ করে? কিন্তু শম্পার জীবনটা যে অন্য রকম, তাই তার কথাতেও পরিপক্বতার ছাপ।
মেয়েটি বলে, ‘আমরা অনেক কষ্ট করছি। আব্বা যখন অসুস্থ আছিল, তহন আমি ভ্যান চালাইছি। অনেকে বলছে যে, মেয়া (মেয়ে) মানুষ ভ্যান চালাইলে বিয়ে অবো (হবে) না। অনেকে অনেক কথা বলছে। আমি তবুও ভ্যান চালাইছি। এহন আঙ্গরে (আমাদের) দুইডে (দুটি) রুম, এডা (একটা) বাথরুম, বারান্দা ও রান্নাঘরসহ দিছে। আমরা খুব খুশি।’
শম্পা বলেন, ‘আমি ভাড়া মাইরে কয়ডা টাকা জমাইছিলাম। সেই টাকা দিয়া এডা (একটা) খাট আনছি; ড্রেসিং টেবিল আনছি। আমরা খুব খুশি। আমরা কিছুদিনের ভিতরেই ঘরে উঠমু। আমি এহন ভালো মতে লেহাপড়া করমু আর বড় হমু।’
বাবা শফিকুল ইসলাম ভাষানী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর তার চিকিৎসার খরচ জোগাতে শম্পা ভ্যান চালাতে বাধ্য হয়। গত বছরের নভেম্বরে ফেসবুকে ছবি ভাইরাল হওয়ার পর তা নজরে আসে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে ভ্যান চালাত জামালপুরের কিশোরী শম্পা।তিনি জামালপুরের জেলা প্রশাসককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেন শম্পার। তারা বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসা করানো হয়।
ডিসেম্বরের শুরুতে শম্পার জন্য বাড়ি করে দেয়ার কাজে হাত দেয় প্রশাসন। তার পরিবারকে দেয়া হয় টাকা। এরপর আর ভ্যান চালানোর দরকার পড়েনি শম্পার।
এক লাখ ৭৫ হাজার টাকায় দুই শতাংশ জমির ওপর নতুন ঘর উঠে গেছে। কিছু কাজ বাকি থাকায় এখনও ওঠা হয়নি।
এই ঘরের জন্য একটি ড্রেসিং টেবিল ও একটি খাট কেনা হয়েছে শম্পার টাকায়।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে ১৯ দিনের চিকিৎসা শেষে এখন কিছুটা হাঁটতে পারেন এক সময়ের শয্যাশায়ী বাবা শফিকুল ইসলাম ভাষানী। আরও ৮ মাস পর তিনি সম্পূর্ণ ভালো হবেন বলে আশা করছেন।
নাকাটি মোড়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে মুদির দোকান চালাচ্ছেন শফিকুল। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দেয়া এক লাখ টাকার মালামাল তুলেছেন সেই দোকানে।
শফিকুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি পড়ার পরে আমার সরকারিভাবে চিকিৎসা চলতাছে। আমারে একটা ঘর দিছে। আমার দোকানে এক লাখ টাকার মাল তুইলে দিল।
‘প্রতিদিন দোকানে দুই হাজার, আড়াই হাজার টাকার বেচাকেনা হইতাছে। আল্লাহ রহমে দিন আমার এহন খুব ভালো চলতাছে।’
দুর্দিন আর আসবে না, এই কামনা করেন শম্পার বাবা। বলেন, ‘আল্লায় আমারে যেভাবে দিছে সেইভাবে এসব ধইরে রাখার ক্ষমতা দেইক, এইডেই আমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।’
চিকিৎসা শেষে ফিরে নতুন দোকানে বসেন শম্পার বাবা। ছবি: নিউজবাংলাপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাও ঝরে পড়ে শফিকুলের কণ্ঠে। বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমি সবসময় দোয়া করি। জীবন ভরা দোয়া করি। আমি যে পর্যন্ত বাইচে আছি, আমার মরা হাড্ডিও প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করব। আমারে যে কাজ কইরে দিছে, আমি জীবনেও এই পর্যন্ত যাইতে পারতাম না।
‘আমি এডা নগণ্য লোক। আমারে চিকিৎসার লাইগে প্রধানমন্ত্রী যে অর্থটা দিছে, আমি তারে সামনে পাইলে পায়ে ধইরে সালাম করতাম। এডেই আমার শেষ ইচ্ছে।’
শম্পার মা নেবুজা বেগম বলেন, ‘আগে এক বেলা খাইতাম। দুই বেলা না খায়ে পুনাই (বাচ্চা) নিয়ে অবেয় (এভাবে) বুহ (বুকে) হাত দিয়ে পইড়ে থাকতাম।’
অভিনয় করে নেবুজা দেখান তার কষ্টের দিনগুলো কীভাবে পার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ঈদ আইলে পুলাপানরে নয়া কাপড়চুপর, ভালো-মন্দ খাবার আমি দিতে পারি নেই। ময়দেমো বাড়াই নেই (বাড়ির বাইরে যাইনি)। পুনাই নিয়ে ঘরে আমি শুয়া থাকতাম। সবাই গুশত দিয়ে ভাত খাইছে, ভালো কাপর পিন্দিছে।
‘আমার পুনাই বাড়াবার পাই নাই। পুনাই কান্দিছে; অবেই বুকে হাত দিয়ে নিয়ে পইরে থাকছি। আমার স্বামী পুনাইরেও কুলে নিবের পাই নাই (কোলে নিতে পারেনি); নাই নাতিরেও কুলে নিবের পাই নাই। এরম এডা দুঃখের দিন গেছে আমার।’ ‘আল্লাহ আমারে এহন এমন এডা সুহে (সুখ) রাখছে। এই সুহের জ্বালায় আমি এহন কান্দিবেরও পাইনে, হাসিবেরও পাইনে (কাঁদতেও পারি না, হাসতেও পারি না)। এহন আমার দুঃখের দিন শেষ। এহন আমি অনেক সুহি’, হাসতে হাসতে বলেন নেবুজা বেগম।আরও পড়ুন: আর ভ্যান চালাবে না শম্পা, দায়িত্ব নিলেন প্রধানমন্ত্রী
জামালপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদা ইয়াসমিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শম্পার নতুন ঘরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘরটি হস্তান্তর করা হবে।’
পাঁচ বছর আগে জামালপুর শহর থেকে বাড়ি ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা ভেঙে যায় শফিকুলের। প্রথমে জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে সাত লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসার পরও ভালো হয়নি তার।
এরপর থেকেই সবসময় বিছানায় থাকতে হয় শফিকুলকে। সবজি বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেন শম্পার মা নেবুজা বেগম। সেই উপার্জনেও যখন সংসার চলে না, তখন বাবার ওষুধের টাকা সংগ্রহ করতে দেড় বছর আগে ভ্যান চালানো শুরু করে শম্পা।