‘দ্বীপির মদ্যি জাল দুড়া (এক ধরনের জাল) টানি বাচাকাচা মানুষ করতি আমাগির খুপ কষ্ট হয়। ইকিনে (এখানে) ঝড় বরষার মদ্যি থাকি। দুর্যোগের সুমায় আমাগির দাঁড়ানির মতন জাগা থাকে না।’
কথাগুলো বলছিলেন ৫৫ বছর বয়সী রাবেয়া খাতুন। একটু থেমে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করেন।
‘২২-২৩ বছর আগে আমার স্বামী জঙ্গলে গেল কাঠ কাটতি। জঙ্গলে গেলি বাঘে ধরিলো। বাঘে মারি ফেললি আমার শ্বশুরবাড়িত্তে তাড়ায় দেলো। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের গালাগালি, তেরেস্কার সহ্যু করতি না পেরি তিনডি ছেলিপেলি নে বাপের বাড়ি অ্যাসি উটিলাম। বাপও মরি গেলো।
‘স্বামী জঙ্গলে গে মরি গেলি কি স্ত্রী অপয়া, অলক্ষ্মী হয়? আমি নাকি স্বামীখেকো! ই রকম কুরি অপবাদ দিত ওরা।’
রাবেয়া থাকেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপগ্রাম গোলাখালিতে। স্বামী সেকেন্দার সানা ছিলেন কাঠুরে। সুন্দরবনে কাঠ কাটতেন।
রাবেয়া নিউজবাংলাকে জানান, ২২-২৩ বছর আগে এক সকালে কয়েক জনের সঙ্গে তার স্বামী যান মাথাভাঙা নদীর পাশে সুন্দরবনের ধজিখালী এলাকায় কাঠ কাটতে। দুই ঘণ্টা পর স্বামীর সঙ্গে যাওয়া লোকজন এসে জানান, সেকেন্দারকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে। পরে বনের মধ্যে তার মরদেহ পাওয়া যায়।
স্বামীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় রাবেয়াকেই।
এই ঘরে থাকেন রাবেয়া খাতুন। ছবি: নিউজবাংলা
রাবেয়া বলেন, ‘একন এই গোলাখালির চরে থাকি। জাল দুড়া টানি। ছাওয়াল দুডো আলাদা হয়ি থাকে। মেয়িডা বে (বিয়ে) দিচি। জামাইডা ভালো। মাঝেমদ্যি খোঁজখবর নেয়। টাকাপয়সাও দেয়। সপ (সব) সময় দিতি পারেনা। ঈদ-টিদ আসলি শাড়ি-কাপড় দেয়। রোগ-ব্যারাম (অসুখ) হলি দ্যাকে। মেয়ি জামাই দ্যাকে বুলি (বলে) তো বেঁচি আচি।
জাল দড়া দিয়ে খাল থেকে মাছ ধরছেন দুই নারী। ছবি: নিউজবাংলা
‘গাঙে জাল টাইনে যে মাছ পাই তা বেচলি দিনে ৩০-৪০ টাকা হয়। তাও আবার কোনো দিন হয় না। ইকিনে সগ্গুলি (সবাই) মাছ ধরে। মাছ কেনবে কিডা কওদিন? এট্টা বাজারঘাট নি (নেই) আমাগির গ্রামে। এট্টা দোকান নি। তালি মাছ ধরি বেচপো কনে? মাছ বেচতি গেলি ৭-৮ মাইল দূরি ভেটখালী যাতি হয়। হদ্দুর (তত দূর) কি আমার মতোন মেয়ি লোকের যাবা সম্ভব?’
তবে এমন দুর্দশা শুধু রাবেয়ার একার নয়। রাবেয়া জানান, গোলাখালিতে ৬২ জন বিধবা আছেন যাদের এক জনের স্বামী মারা গেছে কুমিরের আক্রমণে। বাকিদের বাঘের আক্রমণে।
সবাই তাদের ‘বাঘ বিধবা’ ডাকে। একসময় বাঘ বিধবাদের ডাইনি, অপয়া, অলক্ষ্মী অপবাদ দিয়ে একঘরে করে রাখা হতো। তবে এখন আর সে রকম অবস্থা নেই। অন্যদের সঙ্গে চলাফেরা করতে তাদের নেই কোনো বাধা। কিন্তু অভাব-অনটন তাদের পিছু ছাড়েনি।
রাবেয়া বলেন, ‘সরকার যদি বাঘ বিধবাদের এট্টু সাহায্য করত, তালি সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতি পাত্তাম। সরকার যেন আমাগির দিক এট্টু তাকায়।’
গোলাখালী গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সোহরাব হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, গোলাখালী, কালিঞ্চি মুন্ডাপাড়া, চরপাড়া, গেটপাড়া, বড়খাস খামার ও কলোনীপাড়ায় বাঘ বিধবাসহ ১৬০ জন বিধবা আছেন। তাদের মধ্যে ৩০ জন নারী বিধবা ভাতা পান। বাকিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
গোলাখালীর আরেক বাঘ বিধবা। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি আরও জানান, গোলাখালীর ৮৫ শতাংশ মানুষের জীবিকা সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িত। গ্রামের বাসিন্দা ৩৪০ জন। তাদের মধ্যে ভোটার ১৮০ জন। বাসিন্দাদের প্রায় শতভাগেরই নেই অক্ষরজ্ঞান।
বাঘ বিধবাদের জন্য কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থায় দীর্ঘদিন আছেন পীযূষ বাওয়ালিয়া।
তিনি জানান, তার সংস্থাটি খাদ্যসামগ্রী, কম্বল, ওষুধ দিয়ে বিভিন্নভাবে বাঘ বিধবাদের সাহায্য করে। তাদের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ১০৫০ জন বাঘ বিধবা আছেন।