বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আসাদের ভাঙা ঘরে বইয়ের সুমুদ্দুর

  •    
  • ১৬ জানুয়ারি, ২০২১ ০৭:৪৭

জামালপুরের সরিষাবাড়ীর হাসরা মাজালিয়া গ্রামের আতিফ আসাদ নিজের ভাঙা ঘরে গড়ে তুলেছেন তিন হাজার বইয়ের একটি লাইব্রেরি। স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনেও গড়ে তুলেছেন আরও একটি পাঠাগার। পাঠকরা তার এখানে এসে বই পড়ে। মোবাইলে কল দিলে তিনি নিজে বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসেন। এ জন্য কোনো টাকাও নেন না।

আর্থিক টানাপোড়েনের জীবন। এর মধ্যে বইয়ের নেশা। সংসার আর নিজের খরচ বাঁচিয়ে বই কেনেন তিনি।

শুধু নিজের জন্য নয়, তার সংগ্রহ সবার জন্য। নিজের গ্রামে বেশ বড় একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন তিনি। ২০টি দিয়ে শুরু করা বইয়ের সংখ্যা এখন তিন হাজার।

বইপাগল ছেলেটি বাড়ির পাশাপাশি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে। যাত্রীরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় সেখানে গিয়েও বই পড়েন।

নাম তার আতিফ আসাদ। বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ীর হাসরা মাজালিয়া গ্রামে। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। পাশাপাশি কলেজে চলছে পড়াশোনা।

ফেসবুকের কল্যাণে তার এই সে উদ্যোগের কথা ছড়িয়ে পড়েছে দূর-দুরান্তেও। অজানা, অচেনা মানুষের প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।

অভাবের সংসারে সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট আসাদ। লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে কাঠ ও রাজমিস্ত্রির কাজে সহায়তা করতেন ছোটবেলা থেকেই। পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা।

পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতে অন্য বইও পড়তে চাইতেন। কিন্তু স্কুলে ছিল না কোনো লাইব্রেরি।

ভাবলেন, নিজেই গড়ে তুলবেন। ২০১৮ সালের শুরুতে বড় ভাই মিলনের অনুপ্রেরণায় ২০টি বই নিয়ে ঘরের বারান্দায় শুরু হয় তার সাধের উদ্যোগ।

হাসরা মাজালিয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে আসাদের পাঠাগার

জরাজীর্ণ ঘরে পাঠাগার দেখে শুরুতে বিদ্রূপ করত স্থানীয়রা। তাতে দমে যাননি; বরং দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে তার সংগ্রহ। এখন তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।

এখানে বসে বই ও পত্রিকা পড়া যায়। বই পাওয়া যায় ঘরে বসেই। মোবাইলে কল দিলে নিজেই পৌঁছে দেন পাঠকের হাতে। তাতে কোনো ধরনের টাকা-পয়সাও দিতে হয় না।

এরই মধ্যে জমিসংক্রান্ত বিরোধে খুন হন বড় ভাই মিলন। পরে ভাইয়ের স্মৃতি ও স্বপ্ন ধরে রাখতে পাঠাগারের নাম রাখা হয় ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’।

জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ছেন আসাদ।

নিজের ঘরের পাশাপাশি সরিষাবাড়ি তারাকান্দি স্টেশনের যাত্রীদের জন্য গড়ে ‍তুলেছেন ‘স্টেশন পাঠাগার’।

তারাকান্দি স্টেশনে বই পড়ছেন তরুণ পাঠকরা

আতিফ আসাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলজীবনে যেখানে আমি পড়তাম, সেখানে লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধা ছিল না। আমি বুঝতাম যে একটা ছাত্রজীবনে লাইব্রেরির অনেক অবদান। অ্যাকাডেমিক শিক্ষা বাদে আর সবকিছু জানতে হলে বই অবশ্যই লাগবে। এই জন্যই পাঠাগারটি শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘বড় ভাই মিলন সবসময় আমার সঙ্গে ছিল। যখন আমার ভাইকে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে হত্যা করা হলো, সিদ্ধান্ত নিলাম তার নামটা ধরে রাখতে হবে।’

আসাদ বলেন, ‘যারা বই পড়তে আগ্রহী আমি তাদেরকে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন বাড়িতে গিয়ে বই দিয়ে আসি, আবার নিয়েও আসি।

‘আমার এই পাঠাগারে আমার উপজেলাসহ আশেপাশের উপজেলা থেকেও আসে বই নিতে আর পড়তে।’

স্টেশনে নতুন উদ্যোগের কারণ হিসেবে আসাদ বলেন, ‘আমি যখন দেখলাম এতগুলো এলাকাতে সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে বই দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তখন ভাবলাম আমার বাড়ির পাশেই যেহেতু স্টেশন আছে, এখানে আরেকটা পাঠাগার করতে পারি। এতে আশেপাশের ছেলে-মেয়েরা এখান থেকে বই পড়তে পারবে।

‘স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীরা বিরক্তির পর সময় পার করে। অনেক সময় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে। এই অপেক্ষমাণ সময়টা বই পড়ে ভালো হতে পারে। সেই সঙ্গে এই স্টেশনটা হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতি জাগরণের একটা স্থান।’

আতিফ আসাদ স্বপ্ন দেখেন, দেশের সবগুলো রেলওয়ে স্টেশনে একটি করে লাইব্রেরি থাকবে তার।

তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া মিলন স্মৃতি পাঠাগার এখন পাটখড়ির বেড়াই। এখানে এসে ছেলে-মেয়েদের বই পড়তে অনেক কষ্ট হয়। তাই সবাই যদি আমাকে সহায়তা করে তাহলে ভালো একটি জায়গায় পাঠাগার করতে পারলে আমরা সবাই একসঙ্গে বসে বই পড়তে পারব।’

আসাদের বাড়ির পাঠাগারে সাজিয়ে রাখা বই

আতিফ আসাদের মা জয়নব বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছেলেরে কত কষ্ট কইরে লেহাপড়া করাইছি। আমার ছেলে আজ মিস্ত্রিও কাম করছে, বন্দে কাম করছে। কাম কইরে হাইরে আমার ছেলে লেহাপড়া করছে। এর মধ্যে আমার বড় ছেলেরে মাইরে হালাই দিল। মারলে তাও পাঠাগার থাইকে বিঞ্চত (বিরত) নাই।’

তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের লাইগ্যা আমি খুশি। আমার ছেলে যদি এই কাম না করলোনি, তাইলে তো এত মাইনষের সঙ্গে আমার পরিচয় হইলনি। এত মানুষ দেখবার পাইলনি। আমি জানলামিও না কিছু।’

আসাদের কারণে এলাকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে গড়ে উঠছে পাঠাভ্যাস।

স্মৃতি পাঠাগারে বই পড়তে আসা রতন শেখ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সরিষাবাড়ী থেকে আসছি। এখানে বই পড়ে অনেক কিছু শিখা যায়, জানা যায়।’

আরকে পাঠক রেদওয়ান হাসান বলেন, ‘আগে আমরা বুঝতে পারি নাই যে পাঠাগার কী, লাইব্রেরি কী। এখন জানতে পারছি, অনেক বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারি।’

আরেক পাঠক রাকিব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে আমরা স্কুলে যাইতে পারি না। সেই সময় আমাদের এই পাঠাগারটা হয়েছে। এটা আরও বড় হোক।’

আসাদের পাঠাগারের কারণে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠছে স্থানীয় তরুণদের মধ্যে

হাসরা মাজালিয়া গ্রামের তাপসি জান্নাত সুমি বলেন, ‘অনেকেরই টাকা নেই বই কেনার জন্য। অনেক ছেলে-মেয়ে এখানে এসে বিনা মূল্যে বই পড়ার সুযোগ পেয়েছে।’

স্টেশন পাঠাগারের সামনে অগ্নিবীণা ট্রেনের যাত্রী শাকিল আহম্মেদের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তিনি বলেন, ‘এটা একটি মহতী উদ্যোগ। মানুষ স্টেশনে এসে সময় নষ্ট করে। অবসর সময়ে তারা এখন বই পড়তে পারে। আমরা চাই প্রতিটি স্টেশনে এ রকম পাঠাগার হোক।’

আসাদের লাইব্রেরিতে বই পড়ছেন দুই পাঠক। ছবি: নিউজবাংলা

একই ট্রেনের আরেক যাত্রী রিফাত তালুকদার বলেন, ‘এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে আমি ধন্যবাদ জানাই।’

আসাদের ভূয়সী প্রশংসা করছেন জামালপুরের বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সাযযাদ আনসারী।

তিনি বলেন, ‘যখন গোটা পৃথিবীর মানুষ করপোরেট কালচারের শিকার হয়ে টাকার লোভে মরিয়া হয়ে পড়েছে, সে সময় সরিষাবাড়ীর ডোয়াইল ইউনিয়নের একটি হতদরিদ্র ছেলে যা করেছে, তার কোনো তুলনা হয় না। আমি আশা করি সরকার এখানে এগিয়ে আসবে। তার স্বপ্ন পূরণ করবে।’

এ বিভাগের আরো খবর