‘আমার স্বামীরে আইন্যা দেও। আমার কী সর্বনাশ অইয়া গেল গো। আমি অহন কারে লইয়া তাকবাম, বাচবাম কেমনে।’
এভাবেই বিলাপ করতে করতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন হাওয়া বেগম।
রোববার ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার গাছতলা বাজার এলাকায় বাসের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে হাওয়া বেগমের পরিবারের ছয় স্বজন মারা গেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট জনের বয়স সবে তিন দিন।
পরিবারটির আবাস পূর্বধলা উপজেলার পেচুয়ালেঞ্জী গ্রামে। ময়মনসিংহ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তারা। সেখানে যাওয়ার কারণ নতুন অতিথি আসার উপলক্ষ।
এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মাসুমা বেগম ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ার লিবার্টি হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ১ জানুয়ারি। দুই দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাবা, মা, চাচা, ফুপু, চাচি ও বড় বোনের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল শিশুটি।
নবজাতককে কোলে নিতে অধীর অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা হঠাৎ শোনে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে পথে। শিশুটির বাবা ফারুক আহমেদ, মা সুমা বেগম, চাচা নিজাম উদ্দিন, চাচি জ্যোৎস্না বেগম, বোন জোলেখা বেগম আর অটোরিকশার চালক রাকিবুল ইসলাম- বাঁচতে পারলেন না কেউ।
এরপর পুলিশের গাড়ি যখন ব্যাগে ভরা মরদেহ নিয়ে আসে, তখন রোল পড়ে কান্নার।
বাড়ির আঙিনায় সারিবদ্ধ করে রাখা ছয় স্বজনের মরদেহ। ছবি: নিউজবাংলাগাছতলা বাজারের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী হাওয়া বেগম। তার ১০ বছরের এক ছেলে ও পাঁচ বছরের এক মেয়ে রয়েছে।
শিশু দুইটি বার বার ছুটে যাচ্ছিল বাড়ির আঙ্গিনায় সারি সারি করে রাখা মরদেহগুলোর কাছে। সেখানে তারা তাদের বাবাকে খুঁজছিল।
শোকের সাগরে ভাসা স্বজনরা তখন ব্যস্ত শিশু দুটিকে সামলাতে। নিজেরাই যখন কাঁদছিল, তখন শিশুদেরকে সামলানো চাট্টিখানি কথা না।
নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে প্রাণ হারানো ছোট বোন জুলেখা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সিধলা গ্রামের শিক্ষক বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে। তাদের আট ও চার বছরের দুই মেয়ে।
এই দুই শিশুও তাদের মায়ের কাছে ছুটে যাচ্ছিল। তারা এখনও বুঝতেই পারছে না তাদের মা আর কথা বলবে না।
স্ত্রীর শোকে কাতর বাচ্চু মিয়াও তার সন্তানদের বুঝাতে পারছেন না।
নিহতদের মধ্যে আছেন নিজাম উদ্দিনের ভাবি জ্যোৎস্না বেগম। তার স্বামী আজিম উদ্দিন বাকরুদ্ধ প্রায়।
বাড়িটিতে ভিড় করে নিহতদের আত্মীয় স্বজন, এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধি।
অনেকেই স্মৃতিচারণ করছেন। কেউ কাঁদছেন। কেউ বা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
নিহত নিজাম উদ্দিনের ভাতিজা মাসুম বলেন, ‘দূরের আত্মীয়-স্বজনদের আসার অপেক্ষায় আছি। তারা শেষবারের মতো দেখার পর সোমবার দাফন করা হবে।’
এই নবজাতক নিয়েই ফিরছিলেন স্বজনরা, পথে অটোরিকশাকে বাস ধাক্কা দিলে নবজাতকসহ মারা যান সাত জন। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারটি সড়ক দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে। অথচ আজ আমাদের আনন্দের দিন ছিল। আমার চাচার ছেলে হয়েছিল শুক্রবার দিন। ময়মনংসিংহের ক্লিনিক থেকে বাড়িতে আসতেছিল। তাদের আর বাড়ি আসা হলো না। অসলো তবে লাশ হয়ে।’
নিজাম উদ্দিনের ভাই আজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমার স্ত্রীও গেছে। ভাই-ভাবিরাও গেছে। আমাদের আর কিছু রইল না। এ রকম সব্বনাশ যেন আর কারও না হয়।’
স্থানীয় আগিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঝটকায় পরিবারটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তাদের যা ক্ষতি হয়েছে তা কিছু দিয়েই পোষানো সম্ভব না।’
তিনি বলেন, ‘যানবাহনের চালকরা যদি সতর্কতার সঙ্গে চালান, তাহলে এ ধরনের মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।’
শ্যামগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নয়ন দাস বলেন, ‘বাসটি জব্দ করা হয়েছে। স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়েছে।’
‘এই মৃত্যুর ঘটনায় থানায় মামলা হবে। বাসের পলাতক চালককে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে’-বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।