গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকার দলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে তার পরিবার। লিটনের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন এ দাবি জানায় তার পরিবার।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন লিটন। সেই হত্যাকাণ্ডের চার বছর পূর্তি আজ।
এ উপলক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাসুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা সাহাবাজ মাস্টারপাড়ায় লিটনের কবরে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান । এ ছাড়া কোরআন তেলাওয়াত, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ও অর্থের যোগানদাতা জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) ডা. কাদের খাঁন। ইতিমধ্যে এ মামলায় কাদের খাঁনসহ সাত আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছে বিচারিক আদালত। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী রায়ের বিপক্ষে আপিল করেন হাইকোর্টে।
বিচারিক আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্টেও তা বহালের দাবি করেন এমপি লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি।
তিনি বুধবার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘অধিকতর তদন্ত, সাক্ষ্য প্রমাণ ও আসামিদের দেয়া জবানবন্দির পর আদালত ফাঁসির রায় দেয়। এরপর এ রায় হাইকোর্টে পাল্টানোর কোনো সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি।’
‘বিচারিক আদালতের রায়ে আমরা খুশি। আশা করছি, এ রায় হাইকোর্টও বহাল থাকবে। আমরা রায় দ্রুত কার্যকরের দাবিও জানাচ্ছি।’
আজ সকালে লিটনের কবরে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ছবি: নিউজবাংলা
হত্যাকাণ্ডের পরদিন ১ জানুয়ারি অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন লিটনের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল।
তাহমিদা বুলবুল বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে সঠিক রায় হয়েছে। হাইকোর্ট দ্রুত আপিলের রায় ঘোষণা করবেন এমনটাই দাবি আমার।’
দণ্ডিত কাদের খান ২০০৮ সালে মহাজোটের সমর্থনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে এমপি হন। তিনি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপরহাটি (খানপাড়া) গ্রামের বাসিন্দা।
প্রথমদিকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ভেবে সন্দেহ করা হয় লিটনের স্ত্রীকে। কিন্তু পরবর্তীতে হত্যার মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। একই উপজেলার ধোপাডাঙ্গায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিটন হত্যার রহস্য উন্মোচন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ছিনতাইয়ের ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের স্বীকারোক্তিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাদের খানের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে কয়েক দিন তাকে নজরদারিতে রাখা হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরের কাদের খানের স্ত্রীর মালিকানাধীন গরীব শাহ ক্লিনিক থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
একই বছরের ৩০ এপ্রিল মামলার অধিকতর তদন্ত শেষে কাদের খানসহ আট জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। যা চলে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। এ মামলার বাদিসহ ৫৯ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন।
২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে ছয় জন উপস্থিত ছিলেন। এক জন কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা যান ও অপর আসামি পলাতক রয়েছেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, সাবেক এমপি আব্দুল কাদের খাঁন, তার পিএস শামছুজ্জোহা, গাড়িচালক হান্নান, ভাতিজা মেহেদি, গৃহকর্মী শাহীন, রানা ও চন্দন কুমার। হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে কসাই সুবল কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। আর চন্দন কুমার ভারতে পলাতক রয়েছেন।
এ ছাড়া লিটন হত্যার ঘটনায় অস্ত্র আইনের আরেক মামলায় ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল কাদের খানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
এ বিষয়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্দুল হামিদের দাবি, পরিকল্পিতভাবে তার মক্কেল কাদের খানকে ফাঁসানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে হাইকোর্টের রায়ে কাদের খানসহ বাকি আসামিরা খালাস পাবেন।’
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক কোন্দল ও এমপি হওয়ার লোভ থেকেই পরিকল্পিতভাবে লিটনকে হত্যার ছক আঁটেন কাদের।
‘হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া কিলারদের এক বছর অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণসহ অর্থ ও নানা প্রলোভন দেন তিনি (কাদের)। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই এমপি লিটনকে খুনের পরিকল্পনাসহ নানা প্রেক্ষাপট তৈরি করেন কাদের। যা ৫৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।’
কেন টার্গেটে পরিণত হলেন লিটন:
২০১২ সালে তৎকালীন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন বিভিন্ন অনিয়ম-দুনীতির কারণে কাদের খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের পর কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কাদের রাজনীতিতে যেমন কোনঠাসা হয়ে পড়েন। ঠিক তেমনি জনসম্পৃক্ততা কমে যাওয়ায় তিনি এলাকায় হয়ে পড়েন জনবিচ্ছিন্ন।
এদিকে, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের কাছে পরাজিত হন কাদের।
এ হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ও জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক এমপি কাদের খাঁন।
ওই সময় তরুণ-উদীয়মান ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এরপর নিজ এলাকা সুন্দরগঞ্জে চালাতে থাকেন ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা। এর ফলে কাদের খান আরও কোনঠাসা হয়ে দিক হারিয়ে ফেলেন।
আর এসব কারণেই এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম কাদের খাঁনের প্রথম টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, লিটনের পর দ্বিতীয় টার্গেটে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে হত্যার পরিকল্পনাও আঁটেন কাদের খান। যা মামলার রায়ের বিবরণে বলেছে আদালত।
সেখানে আরও বলা হয়, মূলত লিটনকে সরিয়ে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হওয়ার স্বপ্নে হত্যার পরিকল্পানা করেন কাদের খান। সে অনুযায়ী বাকি সাত আসামিকে অর্থ-বিত্তসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে এক বছর অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেন তিনি।