হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে শেষ মুহূর্তের প্রচারে ব্যস্ত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এখানে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের তিন বিদ্রোহী প্রার্থী। এ কারণে বেকায়দায় দলীয় প্রার্থী।
এদিকে একক প্রার্থী হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে অনেকটাই নির্ভার হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন বিএনপি প্রার্থী।
প্রার্থীরা কনকনে শীত-কুয়াশা উপেক্ষা করে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছুটে যাচ্ছেন ভোটারের বাড়ি বাড়ি। চাইছেন ভোট, দোয়া, সহযোগিতা ও পরামর্শ।
নির্বাচন ঘিরে ভোটারদের মধ্যেও বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। জাতীয় সংসদ বা উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের তেমন আগ্রহ দেখা না গেলেও পৌরসভা নির্বাচনের চিত্র ভিন্ন। স্থানীয় নির্বাচন হওয়ায় এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ বেশি।
২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মেয়র পদে ছয় জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১৪ জন।
এর মধ্যে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাসুদউজ্জামান মাসুক (নৌকা), বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অলিওর রহমান অলি (ধানের শীষ), আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র মো. ছালেক মিয়া (নারকেল গাছ), ফজল উদ্দিন তালুকদার (চামচ) ও আবুল কাশেম শিবলু (জগ) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ইমদাদুল ইসলাম শীতল (মোবাইল ফোন)।
উপজেলা নির্বাচন অফিস জানিয়েছে, ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভার আয়তন ১০ দশমিক ৪০ বর্গকিলোমিটার। মোট ভোটার ১৭ হাজার ৯৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮ হাজার ৮৩৫ জন এবং নারী ভোটার ৯ হাজার ১২৬ জন।
৯টি কেন্দ্রের ৪৬টি কক্ষে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট হবে।
পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অলিগলি ছেয়ে গেছে নির্বাচনী পোস্টার-ব্যানারে। বেলা দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলছে মাইক দিয়ে প্রচার। প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা প্রচারপত্র নিয়ে ঘুরছেন বাড়ি বাড়ি। যাচ্ছেন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে।
মেয়র পদে আওয়ামী লীগের তিন বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বেকায়দায় দলীয় প্রার্থী মাসুদউজ্জামান মাসুক। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র ছালেক মিয়াকে নিয়ে চিন্তিত নৌকার এই প্রার্থী ।
তবে বিএনপি প্রার্থী অলি অনেকটা নির্ভার। এমনিতে তার রয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাসুদউজ্জামান মাসুক জনপ্রিয়তার দিক থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের কাউন্সিলর হওয়ায় বেশ জনপ্রিয়।
ভোটাররা বলছেন, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী মাসুদউজ্জামান মাসুকের সঙ্গে মূলত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বর্তমান মেয়র ছালেক মিয়ার। তবে বাকি দুই প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ফজল উদ্দিন তালুকদার ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম শিবলু তেমন প্রভাব না ফেললেও ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবেন নৌকার প্রার্থীর।
এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্গে বেশ শক্তিশালী আঘাতই হানতে চান বিএনপির প্রার্থী।
অন্যদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী ইমদাদুল ইসলাম প্রচারে সরব নন। যে কারণে তাকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের যেমন মাথাব্যথা নেই, ভোটারদের মধ্যেও নেই আলোচনা।
আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুক বলেন, ‘১৫ বছর আমি কাউন্সিলর ছিলাম। জনগণ আমার দ্বারা উপকৃত হয় বলেই পরপর তিনবার আমাকে কাউন্সিরর নির্বাচিত করেছেন। আমার কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়নে মুগ্ধ হয়ে যেমন দল মনোনয়ন দিয়েছে, আমার বিশ্বাস ভোটাররাও আমাকেই বেচে নেবেন।’
বিএনপির মেয়র প্রার্থী অলি বলেন, ‘প্রচারণার ক্ষেত্রে তেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে না। তবে ইভিএম নিয়ে আমরা অনেক শঙ্কায় রয়েছি। কারণ শুনেছি ইভিএমের মাধ্যমে ভোট সুষ্ঠু হয় না। তাই আমরা চাই ইভিএম বাদ দিয়ে পূর্বের মতো ব্যালটে ভোট গ্রহণ হোক।’ তবে জয়ের ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী বলে জানান।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র ছালেক মিয়া বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচন করব না বলে চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু জনগণের চাপে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করতে হচ্ছে। কারণ বিগত ৫ বছরে আমি শায়েস্তাগঞ্জে উন্নয়নের জোয়ার এনেছি। সুতরাং জনগণ আমার বিকল্প শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় চিন্তাই করতে পারে না।’
আচরণবিধি লঙ্ঘন
অভিযোগ উঠেছে, প্রার্থী ও এজেন্টদের মধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে।
বেলা দুইটা থেকে রাত আটটার মধ্যে মাইকিং করার কথা থাকলে তা মানছেন না কোনো প্রার্থীই। সকাল থেকে শুরু হয় মাইকিং। এ ছাড়া রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মিছিল ও গণসংযোগ করছেন প্রার্থীরা।
এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ রেলজংশন এলাকার ব্যবসায়ী সরাজ মিয়া বলেন, ‘শায়েস্তাগঞ্জ শহর এমনিতেই অনেক ছোটো। এখানে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। কিন্তু নির্বাচনে যানজটের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। প্রার্থীরা মিছিল ও প্রচারণা করছেন শত শত কর্মী-সমর্থক দিয়ে। যে কারণে রাস্তা ব্লক হয়ে যাচ্ছে বারবার।’
পুরান বাজারের ব্যবসায়ী মখলিছ মিয়া বলেন, ‘এক প্রার্থী যেতে না যেতেই আরেক প্রার্থী শত শত সমর্থক নিয়ে আসছেন। এতে শহরে সব সময় যানজট লেগে থাকছে। এর বাইরেও নির্বাচনী যে আচরণবিধি রয়েছে, তার কিছুই মানছেন না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাইকিং করে কান ঝালাপালা করে ফেলছেন।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও পৌর নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আচরণবিধি কিছুটা লঙ্ঘন হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের লোকজন অভিযান চালিয়ে ইতিমধ্যে তিন মেয়র প্রার্থীসহ পাঁচ প্রার্থীকে জরিমানাও করেছে। পাশাপাশি সব প্রার্থীকে হুশিয়ার করে দেয়া হয়েছে যেন তারা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন না করেন।’
ভোটারদের প্রত্যাশা
অনেক ভোটারের অভিযোগ, বিগত সময়ে ন্যূনতম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি পৌরসভায়। মেয়র-কাউন্সিলর মধ্যে বিবাধ-দ্বন্দ্বেই কেটে গেছে পাঁচ বছর। অপ্রশস্ত রাস্তা, অকেজো ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ আর জুয়া-মাদকের ছড়াছড়ি। এতে নাজেহাল পৌরবাসী। নির্বাচনের আগে গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোনো কাজই করেন না মেয়র-কাউন্সিলররা। তাই এবার আর প্রতিশ্রুতি নয়, কাজ করবেন এমন প্রার্থীকেই নির্বাচিত করতে চান তারা।
শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মো. ছমির আহমেদ বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে বিগত ৫ বছরে ন্যূনতম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এখানে পাড়া-মহল্লার ভেতরে প্রবেশ করার মতো অবস্থা নেই। রাস্তা এতটাই সরু যে একটি মোটরসাইকেল নিয়েও ভেতরে ঢোকা যায় না। ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরে আছে। বৃষ্টি হলে কাদাপানি মেখে বাসায় ফিরতে হয়।’
৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মধু মিয়া বলেন, ‘ড্রেনগুলোতে ময়লা জমে দুর্গন্ধে টেকা যায় না। এ কারণে এখন বাসায় থাকা দায়। এ ছাড়া দিনরাত মশার উপদ্রবে আমরা অতিষ্ঠ। আমরা চাই এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করবেন, এমন প্রার্থী যেন এবার নির্বাচিত হন।’
উপজেলা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন রুমি বলেন, ‘আমরা পৌরবাসী চাই এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। দীর্ঘদিনের যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান করবেন এমন প্রার্থীই যেন নির্বাচিত হন।’