শীত আসার আগে সবজির উচ্চমূল্য যেভাবে পোড়াচ্ছিল ভোক্তাদের, শীত আসার পরে তা ভোগাচ্ছে কৃষকদের। কারণ, দাম পড়ে গেছে একবারেই।
শীতের আগে দাম বেশি থাকায় চাষিদের ধারণা ছিল, এবার মুনাফা হবে ভালোই। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি।
উত্তরের বিশাল হাটগুলো থেকে কেবল ওই অঞ্চলে নয়, রাজধানীতেও পাঠানো হয় সবজি। কদিন আগে যেখানে হাটগুলো ছিল ফাঁকা, এখন সেগুলো পণ্যে ঠাসা।
রাজধানীর কাঁচাবাজারের দাম দেখলে কৃষকের দুর্গতি বোঝার উপায় নেই।
সরবরাহ বাড়লে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পাইকারি বাজারে মুলার দাম নেমেছে কেজিপ্রতি এক থেকে তিন টাকা। আর ফুলকপি-বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন টাকা করে।
অথচ কয়েক কিলোমিটার দূরে শহরের বাজারগুলোতেই এই সবজি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে।
বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সবচেয়ে বড় সবজির হাট মহাস্থানগড়। দাম পড়ে যাওয়ায় কারণে সবজি ফেলে দেয়ার অবস্থা কৃষকদের।
জেলায় এ বছর শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ৮১৩ হেক্টর। চাষ লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদনও হয়েছে ব্যাপক। আর এটি কাঁটা হয়েছে কৃষকের। বিশেষ করে ফুলকপি, বাঁধাকপি ও মুলার দাম অর্ধেকেরেও বেশি কমে গেছে।
হাটে দুই সপ্তাহ আগেও ফুলকপি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। সেই ফুলকপির দর এখন নেমেছে প্রতি মণ ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৭০ টাকায়। অর্থাৎ সর্বনিম্ন আড়াই টাকা কেজি দরে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে।
মুলা বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা মণ। দুই সপ্তাহ আগে ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। প্রতিটি লাউ ছয় থেকে আট টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
সদরের লাহেরিপাড়া ইউনিয়নের কৃষক শহিদুল ইসলাম মুলা বিক্রি করার জন্য হাটে এসেছিলেন। বলেন, ‘এখানে সবজি পাঁচ টাকা কেজি বিক্রি হলেও ঢাকায় তা ১০ গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ কৃষকেরা চোখে অন্ধকার দেখছেন।’
একই গ্রামের আরেক কৃষক বুলু মিয়া বলেন, ‘শীতকালে সবজির দামের ক্ষেত্রে প্রতি বছরই তো এমন হয়। এটা তো নতুন নয়। তবে হঠাৎ করে সবজির বাজারে এমন ধস হলেও চাষিরা সমস্যায় পড়েন। এখন সবজির দাম অনেক কম। কিন্তু তারপরও জমি খালি করার জন্য মাঠ থেকে সবজি তুলতে হচ্ছে।’
বাজারে অন্তত ১৫ বছর ধরে কাঁচামালের ব্যবসা করছেন পাইকারি ব্যবসায়ী মো. মোস্তফা। তিনি নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে সবজি বিক্রি করেন। বলেন, ‘কিছুদিন আগেও সবজির আকাল ছিল। কিন্তু এখন হাটে প্রচুর সবজি। আমদানি বেশি হওয়ার কারণে দাম কম।’
খুচরা পর্যায়ে সবজির তাহলে এত বেশি কেন-এমন প্রশ্নে মোস্তফা বলেন, ‘প্রথম বিষয় হলো, ঢাকায় নেয়ার পথে পচে যায়, ওজন কমে। আবার এক ট্রাক সবজি ঢাকায় নেয়ার পথে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতিটি জেলার পুলিশের টাকা টাকা দিয়ে গাড়ি নিতে হয়।’
শিবগঞ্জ উপজেলা কাঁচামাল আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিবাবুল মিয়া বাবু বলেন, ‘সবজির অবস্থা একেবারে খারাপ অবস্থা। চারদিকে সবজির উৎপাদন বাড়ার কারণেই হয়তো দাম এত কম এখন।’
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দুলাল হোসেন জানান, এ বছর চারবারের বন্যার ফলে জমিতে প্রচুর পলি জমে যাওয়ায় উৎপাদন ভালো হয়েছে। লোকসান কমাতে হিমাগার তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গাইবান্ধা
উত্তরের এই জেলায় এ বছর রেকর্ড পরিমাণ জমিতে চাষ হয়েছে শীতকালীন সবজি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। পাইকারি হাটে এক টাকা কেজিতেও ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না চাষিরা। দুই থেকে তিন টাকা দামেও দেখা নেই ফুলকপি-বাঁধাকপির ক্রেতার।
সবজি ভাণ্ডারখ্যাত সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট বন্দরের পাইকারি হাট থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ কয়েক জেলায় সরবরাহ করা হয় সবজি। পাইকারি ব্যবসায়ী আনিছুর রহমান বলেন, ‘১০ দিনের ব্যবধানে সব সবজির দাম কমেছে। তবে বেশি কমেছে মুলা, ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম। এ বাজারে এক টাকায় মুলা, দুই থেকে তিন টাকায় ফুলকপি-বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে। তবুও অবিক্রিত থাকছে এই তিন সবজি।’
মুলা চাষি তন্ময় কুমার সাহা বলেন, ‘জমি থেকে মুলা তুলে বাজারজাত পর্যন্ত ভ্যান ভাড়া আর শ্রমিক খরচের টাকাও উঠছে না। তাই বাধ্য হয়ে মুলা গবাদি পশুকে খাওয়াচ্ছি।’
পলাশবাড়ির কিশোরগাড়ী থেকে ধাপেরহাটে ফুলকপি বিক্রি করতে এসেছেন সাগর মিয়া। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে এ হাটে ফুলকপি কেনাবেচা হয়েছে প্রতি মণ হাজারের ওপরে। অথচ ফুলকপির বর্তমান মণ বিক্রি দেড় থেকে দুইশ টাকা। তারপরেও দিনভর বসে থেকেও ক্রেতা মিলছে না।’
সাদুল্যাপুর উপজেলার বিভিন্ন আড়তে চাষিরা বিক্রি করতে পারছেন না মুলা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি। তবে বেগুন ও সিমের চাহিদা অনেকটাই বেশি আড়তে।
এই আড়তের পাইকারি ব্যবসায়ী ইয়াছিন আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে এমন মুলার আমদানি দেখিনি। মুলার বস্তা রাখার জায়গা নেই।’
সবজির ক্রেতা আনোয়ার হোসেন মনজু বলেন, ‘পাইকারি বাজারে ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম পান না চাষিরা। তবে খুচরা বাজারে এক পিস ফুলকপি ১০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক মাসিদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভালো ফলনের কারণে আমদানি বেশি হয়েছে। তবে এক সঙ্গে আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে ওঠায় দ্রুত কমছে দাম।’
যশোর
মৌসুমের শুরুতে কৃষকের মুখের হাসি মুছে গেছে।
জেলার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার সদরের সাতমাইল, মনিরামপুরের মনিরামপুর বাজার, খাটুরা বাজার, রাজগঞ্জ বাজার, কেশবপুরের কেশবপুর বাজার, বাঘারপাড়ার খাজুরা বাজার। সব জায়গায় একই চিত্র।
কৃষক মিলন হোসেন বলেন, ‘দাম কমছেই। এভাবে চলতে থাকলে লাভের মুখ আর দেখা হবে না।’
রাজগঞ্জ বাজারে ঢাকা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী সিদ্দিক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, এখানে দাম কম হলেও ঢাকায় নিয়ে লাভ করা কঠিন। কারণ, পথে পথে টাকা দিতে হয়।
ঘাটের জ্যামে থাকলে সবজি পচে যায়। আবার বাসি হয়ে গেলে দাম পাওয়া যায় না, তখন লোকসানে পড়তে হয়।
মহাসড়কে পথে পথে ২০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে দিতে দেখা যায় খরচ হয়ে গেছে ৫০০ টাকার বেশি। আবার তিন টনের একটি ট্রাকের ভাড়া আছে ১০ হাজার টাকা, বাজারের টোল ৫০০ টাকা, ঢাকার কারওয়ানবাজারে দুই হাজার টাকা দিতে হয়।
ঢাকার পাইকারি বাজারে যে দরে বিক্রি হয়, তার সঙ্গে খুচরা বাজারে অনেক বেশি পার্থক্যের কারণ এই ব্যবসায়ী জানেন না।
রাজগঞ্জ বাজারের আড়ৎদার তোফায়েল হোসেন তোফা জানান, কৃষকদের কাছে থেকে পণ্য কিনে মণে ৫০ থেকে ৭০ টাকা লাভে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন তিনি।