১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের আগে পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী ছেড়ে গেলেও বিহারি ও মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর পাঁচ দিন সম্মুখযুদ্ধ চলে। ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে বিহারিরা আত্মসমর্পণ করার পর রাজবাড়ীকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্রসহ রাজবাড়ীতে প্রবেশ করে। ওই মাসের প্রথম দিকে তারা সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি ব্রিজ উড়িয়ে ফেলে এবং রাস্তা ভেঙে দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা একে একে হানাদারদের ক্যাম্পগুলো দখল করতে থাকে।
২২ নভেম্বর এমনই একটি অপারেশন চালানোর সময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ খুশী শহিদ হন। হানাদার ও তাদের দোসররা তার মরদেহ ট্রাকের সঙ্গে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে শহর জুড়ে বিজয় উল্লাস করে। এ ঘটনায় রাজবাড়ী জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা কিছুটা কমে যায়। সেই সুযোগে স্থানীয় বিহারি ও রাজাকাররা ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ও বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করে।
যুদ্ধকালীন কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকাউল আবুল হাসেম নিউজবাংলাকে জানান, রাজবাড়ীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ আরও বেগবান করার জন্য যৌথ কমান্ড গঠন করে। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের সব ইউনিট ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদাররা রাজবাড়ী ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।
তবে প্রায় পাঁচ হাজার সশস্ত্র বিহারির সঙ্গে তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছিল। এ সময়ে যশোর থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের নেতৃত্বে ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজবাড়ীতে যুদ্ধরতদের সঙ্গে যোগ দেন।
১৬ ডিসেম্বর সারা দেশ শত্রুমুক্ত হলেও রাজবাড়ী ছিল বিহারিদের শক্ত ঘাঁটি। তারা শহরের প্রধান প্রধান এলাকা নিউ কলোনী ও লোকোসেড কলোনীতে বড় বড় বাংকার তৈরি করে ছয় মাসের খাবার এবং গোলাবারুদসহ অবস্থান নেয়।
রাজবাড়ীতে অবাঙালিদের প্রধান ছিলেন সৈয়দ খামার। তিনি ঈশ্বরদী ও সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত প্রায় ১০ হাজার অবাঙালি বিহারিদের এনে এই এলাকাগুলোতে জড়ো করেন। হানাদার বাহিনীর কাছ থেকেও প্রচুর অস্ত্র সংগ্রহ করে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তোলে।
সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত, সৈয়দ খামারের জল্লাদ বাহিনী তখনও স্টেশন রোডের টর্চার সেলে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পর রাজবাড়ীর আকুয়ার বিল্ডিংয়ে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম অত্যাচার করা হতো। অনেককে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এ অত্যাচারের বিবরণ শুনে আজও শিউরে ওঠে মানুষ।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আশপাশের প্রায় সব এলাকা শত্রুমুক্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজবাড়ী থানা, পুলিশ ক্যাম্প ও ট্রেজারি অফিস থেকে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করলেও শহরের উত্তর দিকে বিহারিদের ঘাঁটি দখলে আনতে পারছিল না।
অবশেষে মাগুরার ক্যাপ্টেন জামান বাহিনী, শ্রীপুরের আকবর বাহিনী, মাচপাড়ার মতিন বাহিনী, পাংশার মালেক ও কমান্ডার সাচ্চু বাহিনী এবং গোয়ালন্দ মহকুমা কমান্ডার শহীদুন্নবী আলমের বাহিনী একসঙ্গে শহরের চর্তুদিক থেকে বিহারিদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়।
১৪ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার আক্রমণের ভেতর দিয়ে রফিক, শফিক, সাদিক, শুকুর, দিয়ানত, জয়নাল মোল্লা, আরশেদ আলী, জাহাঙ্গীর এবং আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের বিনিময়ে অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে শত্রুমুক্ত হয় রাজবাড়ী। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে এলাকার মানুষ।