আজ ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার দামাল সূর্যসন্তানরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে টাঙ্গাইলকে।
যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী দেশের সীমানা পার হয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন।
টাঙ্গাইল জেলার মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক ফজলুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই দেশ শত্রুমুক্ত করতে টাঙ্গাইলে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। ২৬ মার্চ গণমুক্তি পরিষদের উদ্যোগে টাঙ্গাইল সদর থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
২৭ মার্চ বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় টাঙ্গাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া হয়। ওই রাতেই সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। অতর্কিত এ আক্রমণে দুই জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় ও ১৫০ জন আত্মসমর্পণ করে।
প্রথম আক্রমণে ব্যাপক সাফল্য পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মে। এরপর থেকেই গ্রামে গ্রামে যুবকরা সংগঠিত হতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলে প্রবেশের সময় মির্জাপুর উপজেলার গোড়ান-সাটিয়াচড়া নামক স্থানে মুক্তি বাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে।
সেদিনের যুদ্ধে ২৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালায় ওই গ্রামে। চালায় গণহত্যা। এতে শহিদ হন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১০৭ জন বাঙালি ।
পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে আসে। তারা নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ ও সংগঠিত হতে থাকে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়।
বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক যুদ্ধ হয়। চারদিক থেকে আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সংবলিত ফলক। ছবি: নিউজবাংলা
১০ ডিসেম্বর বিকেলে টাঙ্গাইল শহরের উত্তরে পৌলিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রায় ২ হাজার সেনা অবতরণ করায় হানাদারদের মনোবল একেবারে ভেঙে পড়ে। তারা ছুটতে থাকে ঢাকার দিকে।
সেই রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক এমপি টাঙ্গাইল থানা দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
ষাটের দশকের অন্যতম কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল খান মাহবুব ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিউজবাংলাকে জানান, ৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে প্রায় পাঁচ হাজার পাক সেনা ও সাত হাজার রাজাকার আলবদর অবস্থান করে। পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যমুনা নদীপথে পাঠানো হয় সাতটি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
কাদেরিয়া বাহিনী গোপনে এই খবর পেয়ে জাহাজ ধ্বংস করার জন্য মাইন পোতার দায়িত্ব দেয় কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে। জীবন বাজি রেখে মাটিকাটা নামক স্থানে ঘটানো হয় জাহাজ বিস্ফোরণ। দুটি জাহাজে দুই রাত দুইদিন ধরে চলতে থাকে অনবরত বিস্ফোরণ। বাকি জাহাজগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৭২ হাজার সেচ্ছাসেবক নিয়ে গড়ে ওঠে বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী। এই বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। কাদেরিয়া বাহিনীর একের পর এক আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়।
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভোর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে থাকেন এবং সারা শহর নিজেদের দখলে নিয়ে হানাদারদের ধরতে থাকেন। এভাবেই টাঙ্গাইল শহর সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়।
মুক্তির স্বাদ পেয়ে উল্লসিত মানুষ নেমে আসেন রাস্তায়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো টাঙ্গাইল শহর। উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।