মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকাররা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সেই নিষ্ঠুরতার সাক্ষ্য বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণে আজও যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এ জেলায় ঠিক কতগুলো বধ্যভূমি আছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই প্রশাসনের কাছে।
এতে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা শিগগির এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফিউল্যাহ মিজি। একাত্তরে ছিলেন টগবগে যুবক। কাঁধে অস্ত্র নিয়ে ঘুরেছেন। সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জপিঠ। সত্তরের বেশি বয়স। তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে হুইলচেয়ারে।
যুদ্ধ দিনের কথা বলতে গিয়ে তার চোখের তারা জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় আহত বোধ করেন।
তার দাবি, চাঁদপুরের যেখানে যেখানে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে, সরকার যেন সেগুলো ভালোভাবে চিহ্নিত করে। খোঁজখবর নিয়ে শহিদের স্মৃতি রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়। তা নাহলে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতে পারবে না বীর মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের জন্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। জানতে পারবে না কত ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
শহিদদের উদ্দেশে চাঁদপুর শহরের ট্রাকরোড এলাকায় নির্মিত ‘কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর’ স্মৃতিসৌধ অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী চাঁদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছাড়াও নিরস্ত্র অগণিত মানুষকে হত্যা করে।
মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, জেলার ছোটসুন্দর, বাগাদী, দাসাদী ও শিলন্দিয়া গ্রাম, ফরিদগঞ্জ, কাদলা, আহমদনগর, সাচার, গৃদকালিন্দিয়া, বড়কুল, রায়শ্রী, বড়স্টেশন, কাসিমপুর, দত্রা, চরভাগল, রঘুনাথপুর, লাওকরা, রহিমানগর, রসুলপুর ও এনায়েতনগর এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায়।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ আট মাসে চাঁদপুরে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের স্মরণে চাঁদপুর শহরে নির্মাণ করা হয়েছে লেকের উপর ভাসমান ‘অঙ্গীকার’। বোমা বানাতে গিয়ে চাঁদপুরের প্রথম চার শহিদের স্মরণে ‘মুক্তিসৌধ’, সব শহিদের স্মরণে শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় কালিবাড়িতে ‘শপথ ফোয়ারা’ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্মৃতিস্তম্ভও অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কচুয়া উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইয়াকুব আলী ও সদর উপজেলার রামপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের মিজি নিউজবাংলাকে বলেন, চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মিলনাস্থল ‘বড়স্টেশন’ ছিল পাক বাহিনীর নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।
চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘রক্তধারা’। ছবি: নিউজবাংলা
রাজাকারদের সহযোগিতায় অসংখ্য নিরীহ মানুষকে এখানে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই বধ্যভূমিতে ‘রক্তধারা’ নামের একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। অন্য বধ্যভূমিগুলোতে কিছুই করা হয়নি।
তাদের অভিযোগ, জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভগুলোও অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে।
জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শাহানারা বেগম বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার পাশাপাশি যারা শহিদ হয়েছেন তাদের পরিচয় শনাক্ত করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। এতে তারা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হবে। তা না হলে দেশের কোনো সংকটে যুব সমাজ এগিয়ে আসবে না।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ বলেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর দেশপ্রেমের কথা তাদের জানাতে হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, ‘বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকার খুবই আন্তরিক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এলজিইডি থেকে বধ্যভূমির তালিকা চেয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা জেলায় ১৮ থেকে ২০ বধ্যভূমি তালিকাভূক্ত করেছি।’