ছবিতে দৃশ্যমান মাটির রাস্তাটি তিন দশক আগে এমন ছিল না। এখানে এক রেল লাইন ছিল। ট্রেন আসত, বাজত হুইসেল। এলাকার ছোট ছেলে মেয়েরা হৈ চৈ করত, বলত, ‘ওই দ্যাখ, ট্রেন আইছে’।
ফেনী থেকে রেলপথে পরশুরামের দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। ৬৭ বছর এই লাইন ধরে ‘কু ঝিকঝিক’ শব্দে ছুটেছে ট্রেন। কিন্তু লোকসানের কারণে ১৯৯৬ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় তা।
ফেনী-বিলোনিয়া লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নজরদারি কমে যায়। আর সেই সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা। পাথর, স্লিপার, এমনকি রেল লাইন পর্যন্ত তুলে নিয়েছে তারা।
ফুলগাজী উপজেলার মুন্সির হাট ইউনিয়নের বেশিরভাগ অংশেরই লাইন উধাও হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, এখনও রাতের বেলায় অপরিচিত কিছু লোক আনাগোনা করে। যেখানে লাইনের পাত আছে, সেগুলো তুলে নেয়ার চেষ্টা করে।
রেল বিভাগ জানিয়েছে, তারা মামলা করেছে; পুলিশ বলছে, তারা সহযোগিতা করবে। কিন্তু কেউ ধরা পড়েনি, কারও বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি ব্যবস্থা।
লাইন ছাড়াও দুর্বৃত্তদের বলি সড়কের দুই পাশের মূল্যবান গাছও। বিলোনিয়া, পরশুরাম, ধনিকুন্ডা, ফুলগাজী, পুরাতন মুন্সিরহাট, মুন্সিরহাট, আনন্দপুর, দৌলতপুরের পরিত্যক্ত আটটি স্টেশনের যন্ত্রপাতিও খুলে নেয়া হয়েছে।
আট বছর আগে এলাকা পরিদর্শন করতে এসে সেই সময়ের যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, লাইনটি আবার চালু হবে। কিন্তু বাস্তব রূপ দেখেনি সে আশ্বাস। স্থানীয় সংসদ সদস্য শিরীন আক্তার এখনও আশ্বাস দিচ্ছেন, রেল লাইনটি চালু হবে।
রেললাইনটি ছিল পরশুরাম তথা এই অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম উপায়। বিলোনিয়ার রেলগাড়ি ছিল এক সময় ফেনীর উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি ১৯২৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর এক সরকারি আদেশে ফেনী থেকে বিলোনিয়া পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের জন্য ২৫ গ্রামের ২৭৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে।
১৯২৯ সালে সেই লাইন চালু হয়। ১৯৯৬ সালের শুরুতে তৎকালীন সরকার এই লাইন বন্ধ করে দেয়। এখন এসব উপজেলার যোগাযোগের মাধ্যম অটোরিকশা সিএনজি।
২০১২ সালে যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরশুরাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে জানিয়েছিলেন, এই লাইন আবার চালু করতে ৮৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এখন শুধু একনেকে পাস হওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু সেই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি।
ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আলিম বলেন, ‘রেলপথটি মেরামতের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আর যদি তা না হয় বাকি যে রেল লাইন রয়েছে তা সংরক্ষণ করলে সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হবে।’
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশাল এই পথে সম্পদ রক্ষা করার মতো রেলওয়ের পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সম্পদগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।’
লাইনটি আবার চালু হোক, সেটা চান ইউএনও সাইফুল নিজেও। বলেন, ‘বিলোনিয়া স্থলবন্দরে আবার রেল চালু হলে স্বল্প খরচে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্র বেড়ে যাবে।’
লাইন চুরির বিষয়ে ফেনী স্টেশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। কিছু মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। আর পরিত্যক্ত রেললাইনটি আবার চালুর বিষয়ে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে জরিপ চলছে।
ফুলগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘রেল লাইন আলাদা একটি সংস্থা। তারা যদি আমাদের কাছে সহযোগিতা চায় তাহলে আমরা সকল সহযোগিতা করব।’
ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার বলেন, ‘চুরি যাওয়া লাইনটি সচল করে চালু করা হবে। এটি একনেকে ওঠার প্রয়োজন নেই।’