‘আজ কয়েক মাস ধরে স্কুল ছুটি। তাই খালুর পাখি ভ্যান নিয়ে এসে চালাচ্ছি। আমার আব্বা মারা গেছে। তাই খালুর বাড়িতেই থাকি। আমি ভাড়া মারি দুই থেকে ৩০০ টাকা। সেই টাকা মা-খালাকে দি, তারা কিস্তি চালায়; সংসার চালায়।’
কথাগুলো মেহেরপুরের ব্যাটারিচালিত ভ্যানচালক কমলের।
করোনাভাইরাস মহামারিতে শুধু কমল নয়, মেহেরপুরে এমন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কখনও পরিবারের কিস্তির টাকা জোগাড় করতে, কখনও পেটের দায়ে কাজে নেমে পড়ছে শিশুরা।
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এ বিষয়ে প্রশাসনিক নজরদারি নেই বললেই চলে। শিশুশ্রম বন্ধ করে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া হবে বলছেন জেলা প্রশাসক। তবে জেলায় কত শিশুশ্রমিক আছে, সেই পরিসংখ্যানও দিতে পারেনি জেলা প্রশাসন।
জেলা শহরসহ গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার প্রতিটি হাট-বাজার, ওয়ার্কশপ, হোটেল, রেস্তোরাঁয় কাজ করছে শিশুরা। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েলডিং কারখানা ও অবৈধ যানবাহনেও কাজ করছে অনেকে।
পরিবারে অর্থের জোগান দিতেই এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিচ্ছে শিশুরা। অনেক পরিবার একমাত্র উৎস হারিয়ে শিশুদের আয় দিয়েই চালাচ্ছে সংসার। তবে অধিকাংশ শিশুশ্রমিকের আয়ের অর্থই যাচ্ছে এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধে।
পরিবারগুলোর এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কম বেতন দিয়ে শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। যদিও তাদের দাবি, জোর করে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া হয় না; বাবা অথবা নিকট আত্মীয়রা এসে জোর করে কাজে দিয়ে যায়।
ওয়ার্কশপে কাজ করা শিশু শরীফুল নিউজবাংলাকে বলে, বাবা মারা গেছে। সে জন্য সংসারে টাকা-পয়সার অভাব। তিন বেলা খাবার জোটে না। তাই কাজে এসেছে।
লেদশ্রমিক জামাল জানায়, সে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে লেদে কাজে লাগে। তাকে মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন দেয় কারখানা। এ টাকা নিয়ে গিয়ে মাকে দেয়; মা কিস্তি চালায়। এতে সংসারের খরচ মোটামুটি চলে যায়।
মিজান নামে এক শিশুর মা জানালেন অন্য কথা। তিনি বলেন, ‘প্রথমের দিকে স্কুলে যেতে কয়েকদিন ওর (মিজান) বাপের সঙ্গে গিয়ে হাতে টাকা পাইছে। তারপর থেকে আর স্কুলে গেল না। ওর বাপ ভ্যান চালায়; ওর বাপের কাছ থেকে জোর করে ভ্যান নিয়ে যায়।’
লেদ ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘জানি শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তারপরও অভিভাবকরা এসে কাজ শিখার জন্য রেখে যায়। এই জন্য আমরাও রাখতে বাধ্য হই। ওরা আমাদের হুকুম-হাকাম শোনে; চা-বিড়ি এনে দেয় আর ফাঁকে ফাঁকে কাজ শেখে।’
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম নিউজবাংলাকে জানান, জীবিকার তাগিদে অনেকে হয়তো শহরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকতে পারে। তারা চেষ্টা করবেন যথাযথ জায়গা থেকে শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার।
তিনি বলেন, ‘তবে একান্তই যদি কেউ থাকে, যারা অসহায়, জানালে তাদের নিয়ে কাজ করব।’
শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ থেকে দূরে রাখতে জনপ্রশাসন মাঠে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।