মাঠে চাষ করার মত জমি নাই দুই ছেলে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা মোবারক হোসেনের পরিবারে। বয়সের ভারে করতে পারেন না ভারী কাজ। একটু একটু করে জমানো টাকা দিয়ে কিনেছিলেন একটি গরু ও একটি ছাগল। স্বপ্ন ছিল কয়েক মাস মোটাতাজা করে বাজারে বিক্রি করে লাভের মুখ দেখবেন। তা আর হলো না।
নওগাঁর মহাদেবপুরে অবৈধভাবে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের একটি কারখানার দূষণের শিকার মোবারকের গরু ও ছাগলটি।
সীসা কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা ও গবাদি পশু। ধ্বংস হচ্ছে জমির ফসল। ওই এলাকার মাঠের ঘাস খেয়ে গবাদি পশু মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সরেজমিনে দেখা যায়, নওগাঁর মহাবেপুর উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের শাহাজাতপুরে অবস্থিত মেসার্স হাজেরা রাইচ মিলের চারপাশে টিনের তৈরি ঘেরা সীসা কারখানার। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও কাছে গেলেই বোঝা যায়, ভেতরে রয়েছে একটি কারখানা।
সেখানে পুরনো ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কাজ চলে রাতের অন্ধকারে। কারখানায় ধোঁয়ার কারণে আশপাশের এলাকায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিভিন্ন রোগে আক্রান্তও হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে আশপাশের জমির আইলের ঘাস খেয়ে এ পর্যন্ত মোবারকসহ স্থানীয় চারজন কৃষকের ছয়টি গরু ও দুটি ছাগল মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শাহজাদপুর গ্রামের কৃষক মো.মোবারক হোসেন (৬৬) ১৫দিন আগে ১৫ হাজার টাকা একটি গরু কিনেছিলেন মোটাতাজাকরণের জন্য। গত ১২ নভেম্বর সকালে গরু ও ছাগলটিকে ওই কারখানার পাশে জমিতে ঘাস খাওয়ানোর প্রায় দুই ঘণ্টা পর হঠাৎ গরুর মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে। তারপর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ পর গরুটি আমার মারা যায় বলে জানান মোবারক। কিছুক্ষণ পর ছাগলটিও বমি করতে করতে মারা যায়। এত দ্রুত মারা যায় যে, চিকিৎসা করানোর সময় পাওয়া যায়নি।
মোবারক বলেন, ‘আমার দুই ছেলে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। আমাদের খুব অভাবের সংসার। অনেক কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে গরুটি কিনেছিলাম। আর ছাগল গত এক মাস আগে ৩ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। কিছুদিন মোটাতাজা করে বাজারে গরু ও ছাগলকে বিক্রি করব, যাতে করে কয়টা টাকা আয় হয়। কিন্তু আমার আয়ের সম্বল শেষ হয়ে গেল।
‘আমার সুস্থ সবল গরু ও ছাগল মাঠে ঘাস খাওয়ানোর পরেই মারা গেছে। অন্য কোনো রোগ বালাই ছিল না। এর একটিই কারণ ব্যাটারির গলানোর কারণে বিষাক্ত ধোঁয়া জমির ঘাসের সাথে মিশে যায় সেটা খাওয়ার কারণে গরু ও ছাগল মারা গেছে। আমি এর ন্যায় বিচার চাই।’
মোবারক হোসেনের জামাতা মো.শামসুদ্দিন বলেন, ‘পাঁচ দিন আগে সকালে সীসা কারখানার পাশের জমিতে আমার তিনটি গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই এর পর দুপুরে গরুকে বাড়িতে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর গরু তিনটির মুখ দিয়ে বমি হতে থাকে। তার পর মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আমার গরু তিনটি মারা যায়। আমার গরু তিনটির বাজার মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা।
শাহজাদপুর গ্রামের দিলিপ চন্দ্র রায়, জানান গত ১৫দিন পূর্বে আমার একটি গরু মারা যায় ওই সীসা কারখানার পাশের জমি খাওয়ানোর পর। মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গরুটি মারা যায়। আমার সুস্থ গরু কোনো রোগ ছিলনা।
স্থানীয় মুক্তি চন্দ্রা জানান, তিন দিন আগে তার একটি গরু ও একটি ছাগল মারা যায় কারখানার ওখানে জমির ঘাস খেয়ে। কোনো রোগ ছিল না। ঘাস খাওয়ার পর মুখে ফেনা ওঠে মারা যায়।
স্থানীয় খাজুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিউজবাংলাকে বলেন, অবৈধভাবে সীসা গলানো হচ্ছে জানার পর ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার আরিফুল ইসলামকে সেই সীসা কারখানায় কয়েক দিন আগে পাঠালে কারখানার সবাই পালিয়ে যায়। আর যাদের গরু ছাগল মারা গেছে তারা কেউই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নাই। তারপরও আমি খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখব।
সীসা কারখানার মালিক বগুড়া সদরের বাসিন্দা আরিফ হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা তো মাত্র চলতি মাসের সাত দিন সীসা গলানোর কাজ করছিলেন। পরে স্থানীয়দের নানা অভিযোগের কারণে কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
‘তবে আমার সীসা গলানোর কারণে ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে যাওয়ার কারণে সেটা খেয়ে গবাদি পশু মারা গেছে কি-না তা আমার জানা নেই।’
সীসা কারখানা চালানোর জন্য প্রশাসনিক অনুমতি ছিল কিনা জানতে চাইলে, ‘অনেকেই তো নিয়মনীতির বাহিরে গিয়ে এমন কাজ করছে। তাদের কি অনুমতি নেয়া আছে’ বলে ফোন রেখে দেন আরিফ।
জাহেরা রাইচ মিলের মালিক হেমায়েত হোসেন ঝন্টু বলেন, ‘স্থানীয়দের গবাদি পশু মারা যাচ্ছে সেই সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীদের কাছ থেকে পাওয়ার পর আমি গত বৃহস্পতিবার আমার রাইচ মিলে ব্যাটারি গলানো বন্ধ করে দেই।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো.মহির উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, পর্যাপ্ত নিয়মকানুন না মেনে খোলা পরিবেশে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কারণে সেটার বর্জ্য ও ধোঁয়া পরিবেশে যায়, যা পরিবেশ, মানুষ ও গবাদিপশু পাখির মারাত্মক ক্ষতি করে।’
এ বিষয়ে মহাদেবপুর উপজেলা নিবার্হী অফিসার ( ইউএনও ) মো. মিজানুর রহমান ফোনে নিউজবাংলাকে জানান, অবৈধ সীসা কারখানার বিষয়ে জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।