কালজয়ী অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা, সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও কিংবদন্তি কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী চলে গেলেন। গত বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এই গুণী মানুষের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ আমি কখনই আমি পাইনি। সরাসরি কখনও দেখা বা কথা বলারও সুযোগ হয়নি। কিছু ভার্চুয়াল মিটিং বিশেষ করে সম্প্রীতি বাংলাদেশের জুম মিটিংয়ে কয়েকদিন কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কলাম পাঠের মধ্য দিয়ে। আমি আমার সেই ছাত্রজীবন থেকে গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম পড়ে আসছি। তার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমেই তিনি আপন হয়ে গিয়েছিলেন।
রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি যে মানের কলাম লিখেছেন তা খুব সচরাচর দেখা যায় না। এমনকি উন্নত বিশ্বের নামকরা সব সংবাদমাধ্যমেও সেই মানের কলাম খুব একটা চোখে পড়ে না।
গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম মানেই তথ্যের সমাহার। এককথায় তিনি ছিলেন তথ্যভাণ্ডার। তথ্য শুধু স্মৃতিতে ধরে রাখাই বড় কথা নয়, সেই তথ্য প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহার করার মধ্যেই আছে মুনশিয়ানা। আর এই ব্যাপারে গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন যারপরনাই পারদর্শী। আমি যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছি তার কলাম পাঠ করে। অনেকেই ভাবেন গাফ্ফার চৌধুরী যেহেতু ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির উত্থানপতনের প্রত্যক্ষদর্শী তাই সেই রাজনীতি ও ইতিহাসের অনেক তথ্য তিনি জানবেন এটাই স্বাভাবিক।
বিষয়টি আসলে তা নয়। সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি এবং ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ ছিল তার নখদর্পণে। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এমনকি আফ্রিকার অনেক রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং ইতিহাসের নানান ঘটনা ছিল তার দখলে এবং সেসব তথ্য তিনি খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই বিভিন্ন লেখায় ব্যবহার করে পাঠককে সমৃদ্ধ করেছেন।
লেখা অনেকেই লেখেন, কিন্তু অপ্রিয় সত্য কথা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে খুব কম মানুষই বলতে পারেন। গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সেরকম একজন ব্যক্তি যিনি উচিত কথা বলতে কোনোরকম দ্বিধা করেননি। তিনি আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন অথচ সবচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন। বরং বলা যায় গাফ্ফার চৌধুরীর প্রয়াণে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করার আর কেউ থাকল না।
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা বা বদনাম করা আর সমালোচনা করা এক বিষয় নয়। প্রকৃত সমালোচনা বলতে যা বোঝায় সেই সমালোচনাই গাফ্ফার চৌধুরী করেছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তিনি তার অসংখ্য লেখায় বিএনপির প্রচণ্ড সমালোচনা করেছেন কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছেন যে বিএনপির মতো একটি বড় দল তাদের রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল হিসেবে পরিচালিত হোক এবং সে ব্যাপারে তিনি অনেক মূল্যবান পরামর্শ তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন।
কলম চালানোর ক্ষেত্রে এই গুণী লেখক কখনই কোথাও নতিস্বীকার করেননি বা কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলেননি। একবার একটি লেখা নিয়ে তারই এক বন্ধু এবং আমলা এনাম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং চলতে থাকে এই দুইজনের মধ্যে পালটাপালটি কলাম লেখা। এই কলাম যুদ্ধের একপর্যায়ে এনাম আহমেদ চৌধুরী সরে গেলে সেই পালটাপালটি কলাম লেখার অবসান ঘটে।
সেই কলামযুদ্ধে সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের প্রকাশ ঘটেছিল কারণ উভয়ই স্ব স্ব অবস্থান থেকে বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন কিন্তু তাদের দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরেনি। এখানেই গাফ্ফার চৌধুরীর মতো লেখকের বিশেষত্ব। আমরা পাঠাকরা অবশ্য সেই কলামযুদ্ধ থেকে জানতে পেরেছিলাম অনেক কিছু।
গাফ্ফার চৌধুরী লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবে পদচারণা ছিল সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক কলাম লেখক হিসেবে। প্রতিসপ্তাহে ঢাকার একাধিক পত্রিকায় কলাম লিখেছেন নিয়মিত। অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে যখন কেউ কলম ধরতেই সাহস পায়নি, তখন তিনি সব ভয়ভীতি এবং সমালোচনার তোয়াক্কা না করে কলম চালিয়েছেন সাহসী কলমযোদ্ধার মতোই।
গাফ্ফার চৌধুরী প্রথম লেখার পর অন্যরা তখন সেই বিষয়ে লেখার সাহস দেখিয়েছেন। গাফ্ফার চৌধুরীর এরকম তীক্ষ্ণ কলামের বাইরে যে বিষয়টি দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাকে জনপ্রিয় করে রেখেছে তা হচ্ছে তারই লেখা একুশের অমর কালজয়ী গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি”। একটি মাত্র গান লিখে যে একজন গীতিকার এত জনপ্রিয় হতে পারেন তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে গাফ্ফার চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে।
একবার এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এসে বলেছিলেন যে এই গান এত জনপ্রিয় হবে তেমনটা ভেবে তিনি এটা লিখেননি। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত দৃশ্য দেখা সম্পূর্ণ আবেগতাড়িত হয়েই কবিতাটা রচনা করেছিলেন যা পরবর্তীকালে আলতাফ মাহমুদের সুরে গানে রূপ নেয় এবং অমর একুশের প্রভাতফেরির গান হিসেবে গ্রহণ করায় এই কালজয়ী গানটি আন্তর্জাতিকভাবেও জনপ্রিয় হয়।
গাফ্ফার চৌধুরী তার লেখনীর মাধ্যমে বাঙালি জাতির জন্য যা দিয়ে গেছেন তার মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে এবং যতদিন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ টিকে থাকবে ততদিনই তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন। তারপরও তার অবদান এবং লেখাগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তার লেখা তো নিছক লেখা নয়, এসব লেখা হচ্ছে আদর্শের বাণী বিতরণ।
প্রতিটা লেখায় অনেক কিছু শেখার আছে। এসব লেখা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। সে কারণেই গাফ্ফার চৌধুরীর সমস্ত লেখা সন্নিবেশিত করে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে তা সবার জন্য পাঠের সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আর তার রচিত অমর একুশের গান যাতে গ্রিনিচ রেকর্ড বুকে স্থান পায় সেই উদ্যোগও নিতে হবে যদি সেখানে স্থান না পেয়ে থাকে। আমি যতটুকু জানি মান্না দের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’… গানটি বহুল শ্রুত হিসেবে গিনিচ রেকর্ডে স্থান পেয়েছে। সেই বিবেচনায় গাফ্ফার চৌধুরী রচিত অমর একুশের গান সেখানে সবার আগে স্থান পাওয়ার কথা। এব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। একথা ঠিক যে অনেকেই গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে নানান পদক্ষেপ নিবেন এবং অনেক স্মৃতি সংগঠনও গড়ে উঠবে। এগুলো হতেই পারে। তার মতো কিংবদন্তি কলাম লেখকের লেখা একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ এবং প্রচারের ব্যবস্থা না করলে তথ্যের বিকৃতি হতে পারে।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। টরনটো, কানাডা-প্রবাসী।