রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার দুটো কথা আছে। একটা কৃতজ্ঞতার আরেকটা আপত্তির। তার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা।
এক.
কিছুদিন আগে যক্ষ্মায় মারা গেছেন বড় মেয়ে মাধুরীলতা। এই সময়ে কিশোরী রানু তাকে লিখে বসল- ‘আপনাকে দেখতে আমার খু-উ-উ-উ-উ-উ-উ-ব ইচ্ছে করে।’
সন্তানশোকে বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ স্নেহে-প্রেমে আঁকড়ে ধরলেন রাণুকে। তাদের সেই বিধি-ভাঙা অন্যরকম সম্পর্ক এগিয়ে চলল তথাকথিত সামাজিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৫৮, রানুর ১৪।
আর এদের এই অসমবয়সী প্রেমকাহিনি যখন পড়ি তখন আমার ১৮ বছর। বাঙালির ঔচিত্যবোধের মান তৈরি করা নোবেলজয়ী বিশাল এই ব্যক্তিত্বের এমন ‘পদস্খলন’ আমাকে সেই বয়সে বিরক্ত করেছিল। ভেবেছিলাম, ‘মেয়েটি না হয় আবেগী, অবুঝ, কিন্তু আপনি তো বুঝতেন, কেন সাড়া দিলেন? কেন আপনার বিরুদ্ধে প্ররোচনার দায় আনা যাবে না? রণে-প্রণয়ে সব চলে এই যুক্তি কি আপনার বেলায়ও মানতে হবে?’
এখন আমার বয়স ৫৫। এখন আর আমি রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করি না। এখন আমি জানি, ‘আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়।’
দুই.
আমাদের ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। তার পরেও বাসার দেয়ালে ছিল রবীন্দ্রনাথের একটা পেইন্টিং। হাতে আঁকা, দাড়িওয়ালা। তার কোনো লেখা পড়ার আগেই তাকে দেখেছিলাম। ভাসা ভাসা ধারণা ছিল, তিনি কবি।
আব্বার বদলির চাকরিতে প্রতিবছর অনেক জিনিস ফেলে নতুন জায়গায় যেতে হতো। রবীন্দ্রনাথও যেতেন আমাদের সঙ্গে। নতুন বাসার দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার আর পুরোনো রবীন্দ্রনাথ ঝুলত।
তিন.
ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে মাত্র তিনটা কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তাতেই আমার যা হওয়ার তা হতে পারত।
প্রথমটা ‘দুর্লভ জন্ম’।
ক্লাস টেনে প্রথম পড়ি। তারপর যতবার পড়ি, মন্দ্র মন্ত্রের মতো আমাকে শান্ত আর বিনয়ী করে তোলে। পড়ার পর, কাচ পোকা থেকে তিমি, তৃণ থেকে মহিরুহ, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ, তুচ্ছ থেকে মহৎ, সব মহার্ঘ্য বলে মনে হতে থাকে। এই যে ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে মিলে আছি, এই যে চোখের সামনে আস্ত জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সব যেন বার বার নতুন করে দেখতে পাই।
এমনকি যাকে ভালোবাসি, তার দেয়া বিরহ-বেদনাও দিনান্তে মধুর লাগে। প্রেমিকার মুখ মনে করে বলি- ‘‘একদিন তো থাকব না, একদিন তো এই ‘দেখা হয়ে যাবে শেষ’, তখন কার বুকে জ্বালবে তুমি ‘সকল দুখের প্রদীপ?’”
মৃত্যুর কথা পঁচিশেও জানতাম, কিন্তু তখন মানতাম না। পঞ্চান্নতে এসে এখন মানি যে, সত্যিই একদিন মরে যাব এবং সেদিন বেশি দূরেও নয়।
তাই কোনো কিছুই আর গ্র্যান্টেড হিসাবে নিই না। পরিবার-বন্ধু, প্রাণ-প্রকৃতি এমনকি এই যে নিঃশ্বাসটা নিলাম, এই যে এক গ্লাস পানি খেলাম এটাও, উপভোগ করি। তুচ্ছ বলে এতদিন যা চাইনি, ফুরিয়ে যাওয়ার আগে দুহাত ভরে সেসব কুড়িয়ে নিই। ভালোবাসা না পেলেও ভালোবাসি।
চার.
দ্বিতীয়টা ‘কৃপণ’।
কবে পড়েছি মনে নেই। কিন্তু এই বিদ্যা অর্জন করেছি যে, যদি ভালো কাউকে বাসতেই পারি, তাকে যেন অদেয় কিছু না থাকে। কারণ যা দেব তা সোনার কণা হয়ে ফেরত পাব। দিতে পারতাম কিন্তু দিইনি, এই ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা’ দিন শেষে নিজেরই খর্বত্ব হয়ে যেন না দাঁড়ায়। অতএব প্রেমে ও কর্তব্যে, নিজেকে শূন্য করে উজাড় করে দেব, তবেই তা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসে ভরিয়ে তুলবে আমাকে।
পাঁচ.
তৃতীয়টা ‘আবেদন’।
এই কবিতা পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আর পূজার গান এক হয়ে যায় আমার কাছে। প্রেম তো এমনই, কখনও পূজা, কখনও ভিক্ষা, কখনও আহ্লাদ, আর সবটা জুড়ে মায়া। যে ‘কর্ম কেহ চাহে নাই’ সেটাই প্রেমিকের কাজ! এই যে বিত্তবৈভব ব্যস্ততা, এর বাইরে যে স্নানঘরের আয়নার সামনে দাঁড়ানো একাকীত্ব, প্রেমিক তো সেখানেই সঙ্গে মিশে থাকে।
নিবেদনে, আরাধনায়, সম্মানে সে প্রেমিকাকে মাথায় তুলে রাখবে। সে হবে ভৃত্য আর প্রেমিকা হবেন মহারানি। অথচ এই ভৃত্যই পাবেন সেই অধিকার যা জগতের আর কেউ পেতে পারে না। না হয় নাই হলো তার রাজকার্য, নাই থাকল রাজপোশাক, কিন্তু তার প্রেম পুবে-পশ্চিমে অন্তরীক্ষে নিত্য উপস্থিত থাকবে অপরিবর্তনের অর্ঘ্য হয়ে।
প্রতি প্রত্যুষে রানি আসবেন বাগানে। মালাকর ভৃত্য তখন হয়ে উঠবেন নিভৃতের রাজা। মহারানির ‘পদ্মের কলিকাসম ক্ষুদ্র মুষ্টিখানি’ নিজের হাতে ধরে ফুলের চুড়ি পরিয়ে দেবেন। আর সন্ধ্যায়, কর্মক্লান্ত রানি আবার যখন আসবেন। ভৃত্য মহারানির হৃদয়-বাগানের রাজা অশোক ফুলের রাঙা রং দিয়ে আলতা পরিয়ে দেবেন রানির পায়ে। আর, ‘দুটি অতুল পদতলে’ ফুলের রেণু যেটুকু লেগে থাকবে, ‘চুম্বনে মুছিয়া’ দেবে। আহা! এই প্রশ্রয়, এই অধিকার, এক জীবনে না পেলে সে আবার কীসের জীবন?
ছয়.
এবার আপত্তির কথাটা বলি।
‘কিছুই তো হলো না’ এই একটা গান রবীন্দ্রনাথের একবারেই লেখা উচিত হয়নি। এ গান শুনলে আমার বুক ভেঙে কান্না আসে। এক নিরন্তর হাহাকার জেগে ওঠে। কী ভীষণ আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে সব!
অথচ যাপিত জীবনের উদযাপিত কিছু অপূর্ব মুহূর্ত আর স্মৃতির সোনার ধান ছাড়া তো আর কিছুই নেই আমাদের!
লেখক: জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তরের হিউম্যান রাইটস অফিসার