বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গরিবরা ‘নিম্ন’ নয়, অসৎ মানুষ নিম্ন

  • ইকরাম কবীর   
  • ৪ মে, ২০২২ ১৮:৪৬

কাউকে যদি ‘নিম্ন’ তকমা দিতেই হয়- আসুন তাহলে অসৎ মানুষদের নিম্ন বলি। যারা ঘুষ খায়, তারা নিম্ন, যারা খাদ্যের মূল্য বাড়িয়ে গরিবদের কষ্ট দেয়, তারা নিম্ন; যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে- তারা নিম্ন, যারা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে নিজের মনে করে মেরে দেয় তারা নিম্ন; যারা দেশে মাদক প্রসারের পেছনে কাজ করে- তারা নিম্ন।

দেশের সংরক্ষিত নারী আসনের একজন সাংসদ জাতীয় সংসদে বলেছেন- ‘সন্ত্রাস, মাদক— এগুলো নিম্নশ্রেণির ছেলেমেয়েগুলোর জন্যই হয়।’ সন্ত্রাস ও মাদকের কথা বলে তিনি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা আমি খবরটি পড়ে বুঝিনি। তবে তার উক্তিগুলোর মাঝে আমাদের পুরো সমাজের জন্যে বেশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা লুকিয়ে আছে, তা বুঝেছি। সমাজে আমরা শ্রেণিবিভাজন কেমন করে জিইয়ে রাখতে চাই এক ধরনের পরিস্ফুটন ঘটেছে এই বক্তব্যে।

আমি ওই সাংসদের প্রকাশিত কথা ও ব্যবহৃত কিছু শব্দ নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই এবং সেগুলোর উত্তর আশা করি। তিনি হয়তো উত্তর দেবেন না, তবে প্রশ্ন করলে আমার মন শান্ত হবে।

আমার প্রথম প্রশ্ন, ‘নিম্ন’ কে বা কারা? আমরা মানুষকে নিম্ন বলে বিশেষায়িত করি কেন? গরিব মানুষই কি ‘নিম্ন’ মানুষ? গরিব মানুষকে কেন ‘নিম্ন’ বলে ডাকতে হবে? নিম্ন শব্দের অর্থ নীচু বা নীচ। যেই মানুষগুলো আমাদের মতো ‘উচ্চ’দের সেবায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তাদের আমরা ‘নিম্ন’ বলি কেন?

একটু ভেবে দেখা যাক আমরা কাদেরকে ‘নিম্ন’ মনে করি এবং কারা বস্তিতে বসবাস করেন। রিকশাচালক, ফুটপাতের চা-ওয়ালা, গাড়িচালক, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মী, পোশাক-শিল্প কর্মী, যৌনকর্মী। আরও কত রকমের পেশাজীবী সেখানে বসবাস করে তা আসলে আমরা জানি না। হয়তো আইন-শৃঙ্খলাকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী এবং সরকার জানে।

একবার চিন্তা করুন এসব ‘নিম্ন’কর্মীরা না থাকলে আমাদের মতো ‘উচ্চ’দের জীবনযাপন কেমন হতো? তাদের সেবা না থাকলে আমাদের মতো ‘শিক্ষিত’ মানুষ কেমন করে বাঁচত? সাংসদরাই বা বাঁচত কেমন করে? আমাদের সংসদ ভবন পরিষ্কার রাখে কারা? সেখানকার প্রক্ষালন কক্ষ কারা পরিষ্কার করে? আমাদের এই সাংসদের বিশ্বাস আমলে নিলে বুঝতে হবে যে ‘নিম্ন’শ্রেণির মানুষ এসব পেশায় নিয়োজিত। এই পেশাগুলোতে যারা নিয়োজিত, তাদেরই আমরা ‘নিম্ন’ বলে আখ্যায়িত করি।

আমরা শত শত বছর ধরেই এই উচ্চ-নিম্ন বিভাজন সমাজে দেখছি এবং ইচ্ছে করে এই বিভাজন জিইয়ে রাখছি, ‘উচ্চ’দের স্বার্থে। প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের ‘উচ্চ’ মনে করে বৃহৎ এক জনসমষ্টিকে ‘নিম্ন’ মনে করতে কেন চাই।

সাংসদ বলেছেন, দেশে শিক্ষিত মানুষের ছেলেমেয়ে কমছে আর বস্তির ছেলেমেয়ে বাড়ছে। এই বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই, তবে প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষিত মানুষ কারা? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ালেখা করেছেন, তারা? তা-ই যদি হয়, তাহলে বস্তির ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পায় না কেন? নাকি আমরা ইচ্ছে করে সুযোগ দিই না? ‘নিম্ন’দের ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে উচ্চতায় আসুক তা বোধহয় আমরা চাই না। বস্তির ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হোক তা কি আমরা আসলেই চাই?

তিনি বলেছেন, ‘উচ্চপর্যায়ের লোক, মধ্যবিত্ত, যাদের সন্তান দেশে ডাক্তার হতে পারবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে, বৈজ্ঞানিক হতে পারবে- দেশকে কিছু দিতে পারবে, এদের সংখ্যা বাড়ছে না। এদের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে।’

এ কথার অর্থ পরিষ্কার। এর অর্থ হচ্ছে, ‘নিম্ন’দের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে না তা নয়, তবে সীমিত সংখ্যায় হচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক গরিব ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে যাদের ছাত্রাবাসে বসবাস করে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি নেই। তারা লেখাপড়ায় ভালো। লাখ লাখ শিক্ষিত মানুষের ছেলেমেয়ে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারে না, কিন্তু গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা পারে। এই পারাটা কম কথা নয়। অনেক উচ্চপর্যায়ের একটা কাজ।

একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোতে পারলে এদের আর কেউ ঠেকাতে পারে না। এরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা, ব্যাংককর্মী– এসব কাজে নিজেদের স্থান করে নেন। আমরা তখন তাদের নিয়ে সংবাদপত্রে খবর ছাপি। এক হোমরাচোমরার সন্তান ইঞ্জিনিয়ার হলে কেউ তা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না, কিন্তু একজন পোশাককর্মীর সন্তান তা হতে পারলে সেটি খবরের কাগজে স্থান পায়।

এ কথা বলছি তার কারণ হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও পরিণত হতে এখনও বেশ দূরে অবস্থান করছে। যে কারণে ওই সাংসদ গরিবদের ‘নিম্ন’ বলে ডাকছেন, ঠিক সেই একই কারণে আমরা কোনো-কোনো গরিবকে সুযোগ করে দিয়ে, বাহবা দিয়ে বলব– ‘তুমি পেরেছ; আজ থেকে তুমি আমাদের’।

আমাদের মনের মাঝে এই দৃষ্টিভঙ্গি জেঁকে বসে আছে।

প্রশ্ন রেখেছিলাম– ‘বস্তির ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হোক তা কি আমরা আসলেই চাই?’

আমি বলি, ‘না; চাই না’। চাইলে তো অনেক আগেই পারতাম। গরিবদের সাহায্য করতে চাইলে, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দিতে চাইলে, আসলে এত সময়ের দরকার হয় না। তাহলে কেন এই সময় লাগছে? সময় লাগছে তার কারণ হয়ত দারিদ্র্য বিমোচনকারীরা (যারা সবাই উচ্চ) দরিদ্রদের দারিদ্র্য অবস্থা বজায় রেখে হয়ত দেখাতে চান যে, তারা দারিদ্র্য বিমোচনে আপ্রাণ কাজ করে যাচ্ছেন।

বস্তির (গরিব মানুষের) ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে দেশে শ্রেণিসংঘাতের আশঙ্কার কথা জানান এই সাংসদ। তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষিত মানুষের ছেলেমেয়ে কম, বস্তির ছেলেমেয়ে অনেক বেশি। তারা সব বাড়িঘর দখল করতে আসবে। আর বলবে, তোমাদের ছেলেমেয়ে কম, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক কর। একটা বিরাট শ্রেণিসংঘাত সৃষ্টি করবে।’

তার আসল ভয়টা এখানেই। শ্রেণিসংঘাত। ভীষণ ভয়। এই ভয় শুধু আমাদের সাংসদের নয়; আমরা যারা সুবিধাপ্রাপ্ত সবার ভয় যে একদিন শ্রেণিসংঘাত হতে পারে। সুবিধাবঞ্চিতরা একদিন ধেয়ে এসে আমাদের সব কিছু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে পারে। আমাদের বড় বড় বাড়ি, গুলশান-বনানীতে যেখানে খালি এক বা দুজন মানুষ বাস করে এমন বাড়ি আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

সাংসদের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে যে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে যাচ্ছে, যা শিক্ষিতদের জন্য হুমকি। নিম্নশ্রেণির মানুষ উচ্চশ্রেণির ধন-দৌলত দখল করে নিতে আসতে পারে। হ্যাঁ, অবশ্যই; গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তা দৌলতবাদীদের জন্য অবশ্যই বিপজ্জনক সংবাদ। আমাদের সাংসদ সে কারণেই তার বক্তব্যটি সংসদে পেশ করেছেন।

এই ভয় আমরা সবাই পাই। সারা বিশ্বের সব ধনী এই ভয়ে থাকে। তবে গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে যে ধনীদের জীবনে বিপদ আসতে পারে তা অনেক দেশের ধনী ভালো বোঝে। সে কারণেই সেসব দেশের ধনীরা এমন এক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা চালু রাখে যেন হতদরিদ্রের সংখ্যা না বেড়ে যায়। ওই সব দেশে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা অনেক মজবুত থাকে।

মজবুত রাখা হয় এ কারণেই যেন গরিবের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে শ্রেণিসংঘাত সৃষ্টি না হয়। সেসব দেশে, গরিব মানুষদের ধনীরা কেউ ‘নিম্ন’ বলে ডাকেন না। মনের ভেতরে থাকলেও মুখে বলেন না। গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের জন্যও অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দেন, যেন তারা দরিদ্র অবস্থা মেনে নিয়ে শান্ত থাকেন; ধনীদের সম্পদ দখল করে নেয়ার কথা ভাবেন না। ধনীরা একটি বিষয় নিশ্চিত করেন যেকোনো অবস্থায়ই গরিবরা যেন না ভাবে যে, ধনীরা তাদের অবজ্ঞা করছে।

বাংলাদেশের ‘উচ্চ’ এবং ধনী মানুষেরা এমন নয়। তারা গরিব মানুষকেই সবার আগে অবজ্ঞা করবে এবং তাদের ‘নিম্ন’ বলে আখ্যায়িত করবে। গরিবরা আসলে গরিব তা সুযোগের অভাবে। এই সুযোগ কতটুকু তৈরি করে দেব তা নির্ভর করছে ধনীদের বুদ্ধিমত্তার ওপর। বিত্তশালীরা পরিণত হলেই তবে দারিদ্র্যনিয়ন্ত্রণ করা যায়। এমন ব্যবহার করতে হবে ও এমন ব্যবস্থা চালু করতে হবে যে, দরিদ্র মানুষ যেন না বোঝে তারা দরিদ্র। এই চিন্তা আমাদের উচ্চবিত্তের বর্ণবাদী মস্তিষ্কে খেলে না।

আমরা জানি যে আমাদের দেশে গরিবরা কোনোদিনই ধনী হবে না, তবে আমাদের ধনীদের কাছ থেকে মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয়ার মানসিকতা আশা করি। কাউকে যদি ‘নিম্ন’ তকমা দিতেই হয়- আসুন তাহলে অসৎ মানুষদের নিম্ন বলি। যারা ঘুষ খায়, তারা নিম্ন, যারা খাদ্যের মূল্য বাড়িয়ে গরিবদের কষ্ট দেয়, তারা নিম্ন; যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে- তারা নিম্ন, যারা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে নিজের মনে করে মেরে দেয় তারা নিম্ন; যারা দেশে মাদক প্রসারের পেছনে কাজ করে- তারা নিম্ন।

জেনে রাখুন, গরিব মানুষ ‘নিম্নশ্রেণি’ নয়। তারা জোগানদাতা। তাঁরা না থাকলে আপনার-আমার চাকা ঘুরবে না।

লেখক: গল্পকার এবং সংযোগ পেশায় নিয়োজিত

এ বিভাগের আরো খবর