আমরা যারা জেলা-উপজেলা শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ থেকে রাজধানীতে এসেছি, তারা জানি ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা, ঈদের আনন্দ মানেই বাড়ি ফেরার আনন্দ, ঈদের উৎসব মানেই নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে বয়ে যাওয়া সীমাহীন উল্লাস। জীবনের তাগিদে ঢাকা শহরে ঘাঁটি গাড়লেও শহরটি যে আপন হতে পারেনি, বাড়িফেরা মানুষের পরিসংখ্যানই তা বলে দেয়। এ বছর ঈদে এক কোটি বিশ লাখের বেশি মানুষ ঢাকা ছেড়েছে।
তাই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাস, লঞ্চ বা স্টিমারের টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় কোনো আপত্তি নেই। তীব্র গরম উপেক্ষা করে সারারাত রেল স্টেশনে শুয়ে বসে সকালবেলা টিকিট হাতে পেয়ে রাজ্যজয়ের প্রশান্তিই যেন একমাত্র সত্য, বাকি সব অর্থহীন। আবার অনেকেই একজোট হয়ে আস্ত একটা বাসই ভাড়া করে ফেলে শুধুই ঈদে বাড়ি যেতে হবে বলে। আকাশ-নৌ, সড়ক-রেল যেভাবেই পারে বাড়ির পানে ছুটছে মানুষ। ঈদ বলে কথা; ঈদে বাড়িতে না ফিরলে জীবন যেন অসমাপ্ত থেকে যায়, আনন্দে বিষণ্ণতা ভর করে।
পৃথিবীর অল্পকিছু সংখ্যক শহরের মধ্যে ঢাকা একটি, যেখানে মানুষ সারাজীবন বাস করলেও ধর্মীয় উৎসবগুলো এই শহর টানে না। তাই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে, নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করে, সীমাহীন দুর্ভোগ সত্ত্বেও, দুর্ঘটনার ভয়ংকর আশঙ্কার পরেও সেই গ্রামেই ফিরতে চায় মানুষ। এমনকি গত দুই বছরে মহামারিতে নানারকম বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেও ঈদে মানুষ গ্রামেই ছুটেছে।
প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে নিজের শেকড়ে উৎসব পালন করার সুতীব্র বাসনা থেকেই মানুষের ঘরে ফেরার এই তাড়না। ইট-সিমেন্ট পাথরের ঢাকা শহর মানুষকে কর্মসংস্থান দিতে পারলেও, পারেনি ভালোবাসার বাঁধনে জড়াতে। তাই শহুরে মায়া-মমতাহীন জীবন পেছনে রেখে একটুখানি নরম হাতের কোমল পরশ পেতে, শীতল বাতাসের স্পর্শ গায়ে মাখতে, তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে লুটোপুটি খেতে, প্রিয় মানুষগুলোর আদরে মোড়ানো সান্নিধ্য পেতেই মানুষকে ঘরমুখো হতে অসীম শক্তি জোগায়। এটাই বোধহয় বাঙালির শাশ্বত বৈশিষ্ট্য। নাড়ির টান যে বড় টান। শেকড়বিচ্ছিন্ন মানুষ ছাড়া আর কারো কি সাধ্য আছে এই টান উপেক্ষা করতে পারার!
ঢাকা অত্যধিক ব্যয়বহুল নগরী হলেও কাজের সহজলভ্যতার কারণে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে ভালোভাবে টিকে থাকার নিমিত্তে বা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে, বাচ্চাদের ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে, একটু উন্নত জীবন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জনগোষ্ঠী এ শহরটিকেই প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিয়েছে। যাদের অধিকাংশেরই এ শহরে নিজেদের কোনো বাড়ি বা আবাস নেই, মাথাগোঁজার নিজস্ব কোনো ঠাঁই নেই। বেশিরভাগ মানুষই থাকেন ভাড়া বাসায়, মেসে বা অন্যকোনো পন্থায়।
আয়-ব্যয়ের অসংগতির কারণে অনেকেই টিকতে না পেরে পরিবার গ্রামে রেখে শহরে একাকী থাকেন। প্রাণপ্রিয় সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী, জন্মদাতা পিতা-মাতা, ভাইবোন আত্মীয়স্বজন সবাই যে গ্রামে। সেই গ্রামকে অগ্রাহ্য করে কী করে?
সংগত কারণেই সেই মানুষগুলো এ শহরকে আপন ভাবতে পারে না বা ভাবার মতো যথেষ্ট কারণও নেই। এই নির্মম সত্য বুকে ধারণ করেই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষেরা ঢাকা শহরকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এই শ্রেণির বাসিন্দা জানে, তারা যে অর্থনৈতিক কাঠামোতে বাস করে, যেকোনো সময়ই উচ্ছেদ হতে পারে সেখান থেকে। এখানে রোজগারের সুবিধা যেমন আছে, তেমনি হঠাৎ করেই নিঃস্ব হওয়ারও ঝুঁকিও আছে। অনিশ্চয়তার এই সংকটের কারণে মানুষের মাঝে সবসময় আতঙ্ক বিরাজ করে।
মানুষ ভাবে কোনোভাবে পা পিছলে গেলে আর নিস্তার নেই, তাকে এ জাদুরশহর ছাড়তেই হবে। ফিরে যেতে হবে সেই গ্রামেই। গ্রামই তাকে বুক পেতে নেবে। সবার হৃদয়ের গভীরে ‘নিজস্ব ঠিকানা’ বলে যে জিনিসটি প্রোথিত আছে, তা গ্রামের নিজের বাড়িই। ভাঙাচোরা হোক, কুঁড়েঘর হোক, বিল্ডিং হোক নিজেরই বাড়ি, স্থায়ী ঠিকানা। তাই ঈদ-পার্বণে দিন কয়েকের জন্য নিজের রাজ্যে রাজা হতেও ছুটে যাওয়া সেই গ্রামেই।
ঈদের কয়েকদিন বড় শহরগুলোতে সুনসান নীরবতা বিরাজ করলেও দেশের প্রায় সব ছোট শহর আর গ্রামগুলো কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে। নিত্যনতুন সাজে আবালবৃদ্ধবনিতাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় রাস্তাঘাটে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, পাড়া-মহল্লার মোড়ে, চায়ের দোকানে, পুকুর পাড়ে, নদীর ঘাটে। প্রাণচাঞ্চল্য বয়ে যায় জনপথ থেকে জনপদে।
ঈদে অনেকেই বিদেশভ্রমণে যান পরিবার-পরিজন নিয়ে। যাদের অর্থের সীমা পরিসীমা নেই, তাদের বাড়িরও অভাব নেই; সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম, বেগম পাড়া আরও কত কী! কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের একটাই হোম নিজের গ্রাম, নিজের বাড়ি।
এ দেশের শহুরে আভিজাত্য যেমন গ্রামে ঢুকতে পারে না, ঠিক তেমনি গ্রামের স্নিগ্ধতাও শহরকে স্পর্শ করে না। তাই নিত্যনতুন নান্দনিক অবকাঠামো আর নিয়ন আলোর ঝলকানিতে শহরের সৌন্দর্যে মোহিত হলেও, শেকড় তাকে টানে, প্রবলভাবেই টানে।
ঈদের আনন্দ-যাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই নিরানন্দের সুর বেজে ওঠে। দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ প্রাণ হারায়, পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় একটা অংশকে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনাকালে চলাচলের বাধ্যবাধকতার দুই বছরসহ গত পাঁচ বছরে শুধু ঈদে ১ হাজার ৫ শর বেশি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫ শর অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে ৫ হাজারের অধিক মানুষ; যাদের বড় একটা অংশ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণে বাধ্য হয়েছে।
এবার ঈদে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ দ্বিগুণ থাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ঈদের স্বপ্নযাত্রায় যে অশনিসংকেত বেজে ওঠে, তার ভয়ংকর পরিণতি বহন করে চলতে হয় জীবনভর। একটি দুর্ঘটনায় কর্মক্ষম একজন ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শোচনীয় আর্থিক দৈন্যদশায় পঙ্গু হয়ে যায় সেই পরিবারটিও। বিবর্ণ বিষণ্ণ বর্ণহীন জীবন কাটাতে হয় সেই পরিবারের বাকি সদস্যদের।
মহামারির অতিশয় প্রাবল্য কমে এসেছে, তবুও যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। যে মায়া-মমতার টানে শেকড়ে ফিরি, সেই মায়া যেন ছড়িয়ে দিতে পারি সবখানেই। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ঈদের আনন্দে বন্ধন তৈরি হোক মানুষে-মানুষে, অনাবিল প্রশান্তি বয়ে যাক অন্তরে। মঙ্গল হোক সকলের।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক