প্রতিবেশীর দরজায় কান পাতলেই এখন একটা কথা খুব শোনা যায়, ‘আমার বাচ্চাটা মোবাইল ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না’। আরেক পা এগোলে শোনা যাবে ‘কার্টুন না দেখে আমার বাচ্চাটা থাকতেই পারে না, খেলতে চায় না, কারো সঙ্গে মিশে না’। এমনিভাবে সদা ব্যস্ত জীবনে জড়িয়ে থাকা মা-বাবাদের সন্তান নিয়ে গল্পের প্রায় বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির কথা। কখনও আক্ষেপ-হাহাকার আবার কখনও ঔদ্ধত্য-অহমিকা ঝরে পড়ে সে আলাপে, গল্পে। কিন্তু এভাবে যে অল্প অল্প করে প্রতিদিন আমরা সন্তানদের মনোজগতের বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছি তা কি টের পাই?
লীলা মজুমদার লিখেছেন- “নতুন বইতে নাক ডুবিয়ে যে ছোট ছেলে-মেয়ে পাঁচ মিনিট তার গন্ধ উপভোগ করেনি, সে বড় হতভাগা, সে আর কী বলব”। পরীক্ষা পাসের মুহুর্মুহু চাপে ক্লিষ্ট যে জীবন ‘আউট বই’ ছুঁতে পারে না তাকে তো হতভাগ্য বলতেই হয়। বোকাবাক্সের সামনে কাটানো রিক্ত-নিরানন্দ, আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন শৈশব ভবিষ্যতের কেমন বড় মানুষ উপহার দিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
শিশু মনের কল্পনাশক্তিকে যন্ত্র দিয়ে চেপে ধরে মূলত আমরা একটা সার্থক, হৃদয়বান, পূর্ণাঙ্গ মানুষের বিকশিত হওয়ার পথটাকে বন্ধ করে দেই। সাফল্যের গৎবাঁধা ইঁদুরদৌড় একটা কোমল, স্নিগ্ধ পুষ্প সদৃশ স্বর্গ শিশুর কল্পনাশক্তিকে বিকশিত হতে দেয় না, তার সৃষ্টিশীলতার সব পথকে সংকীর্ণ করে দেয়। অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পাঠকের ভাববিশ্ব, পাঠতন্ত্র ও অন্যান্য’ প্রবন্ধে বলেন- “শিশুবেলার কল্পনা প্রবণতার মধ্যে বড়বেলার স্বাধীন সৃষ্টিশীল ও আনন্দময় জীবনের মূল সোপানটি নিহিত থাকে। এটি তৈরি করে মানবিক নৈতিকতার ভিত্তিভূমিকে। মুখ গুঁজে চোখ ছোট করে অবচেতনে বোনে স্বপ্নাশ্রয়ের আবাসস্থলটিকে।”
কাজেই শৈশব থেকেই শিশুর ভেতরে একটা পাঠকসত্তা তৈরি করতে না পারলে, সিলেবাসের বইয়ের বাইরে ছড়িয়ে থাকা অযুত ‘চাঁদের পাহাড়’-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব না ঘটাতে পারলে এক বিষণ্ন, জৌলুশহীন, নৈরাশ্যবাদী, একাকী, স্বার্থপর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমরা উপহার পাব সেটা অবলীলায় বলে দেয়া যায়।
প্রিয়তম সন্তানের জন্য মধ্যযুগের ঈশ্বরী পাটনীর প্রার্থনা ছিল ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। আর এই সাফল্যকাঙাল যুগে সন্তানের জন্য মা বাবার কত চাওয়া! সেই চাওয়ার ভীষণ ভিড়ে শিশুর মনোজাগতিক উৎকর্ষতার ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়। এই, সেই বানানোর স্বপ্নোন্মাদনায় পাত্তাই পায় না সন্তানকে ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার ভাবনাটি। অথচ আজও বড়রা প্রায়ই শিশুদের আশীর্বাদ করার সময় বলেন, ‘মানুষের মতো মানুষ হও’। এই ‘মানুষের মতো মানুষ’ হওয়ার বিষয়টা কিন্তু ভিন্ন এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
একটা শিশুর ভাবনার বিকাশলগ্ন থেকে যদি তার বোধের ভিত্তি তৈরি হতে থাকে জগতের বহুবিধ রূপ-মঞ্জুরী মিশ্রিত বইপত্রের সঙ্গে সখ্যে, তবে আশা তৈরি হয় ভবিষ্যতের এক দীপ্র মানুষ পাওয়ার। শিশুকাল থেকেই সন্তানদের যদি আমরা বইপত্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে দিতে পারি, তাকে যদি ‘আউট বই’য়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারি তবে তার ভাবনার আকাশটা অনেকখানি প্রশস্ত হতে পারে। তার চিন্তার পৃথিবী অন্যরকম হতে পারে। বিচিত্র বই পাঠের অভিজ্ঞতা তাকে জ্ঞানের অসীম রাজ্যে অবগাহনের সুযোগ করে দেয়।
আমরা অভিভাবকেরা প্রায়শই ভুলে যাই, শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দাবারের সঙ্গে মনেরও খোরাক প্রয়োজন। সন্তানদের আনন্দ দেয়ার জন্য শুধু পার্ক নয়, এর বাইরেও বিপুল আয়োজন রয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, মা-বাবারাইবা কতটুকু ‘কাজের পড়া’র বাইরে গেছি কিংবা যাই! এ পৃথিবীর রোমাঞ্চ কতটুকু আর দেখার চেষ্টা করেছি। কেবল ‘চাই চাই’ করা জীবনে মানবিকতার বীক্ষা কিংবা ভাবজগতের রূপ-রস-গন্ধ কতটুকু ছুঁতে পেরেছি নিজেরা, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
আর অভিভাবকদের এই নিরানন্দ, হতাশ জীবনের প্রভাব পড়ছে সন্তানদের ওপর। আজকাল শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীজুড়ে কিশোর-তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। বাড়ছে বহুবিধ মানসিক সমস্যা। এর কারণগুলো খুঁজলে হয়ত নানা রকমের তথ্য পাওয়া যাবে কিন্তু মানসিক বৈকল্য কিংবা চিন্তার উন্নাসিকতার কথা অস্বীকার করা যাবে না। যখন তখন ‘মন খারাপ’-এর মতো অসুখ তাদের ভোগায় নিরন্তর। পরিবারের মাঝেও তারা একলা থাকতে চায়, প্রকৃতির ছড়িয়ে থাকা জীবনের মণি-মাণিক্য তার ভালো লাগে না, আচার আচরণে মুহুর্মুহু বৈপরীত্য দেখা দেয়। আর তখনই প্রকাশ পায় মা বাবার অসহায়ত্ব।
বইয়ের দুনিয়া দিতে পারে এক প্রশান্ত জীবনের ইশারা। ভবিষ্যতের ‘আসল বেঁচে থাকা’র পথ বাতলে দিতে পারে শৈশব-কৈশোরের পাঠাভ্যাস কিংবা বিচিত্র জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ। মানব জীবনের মহানুভব অস্তিত্বটিকে অনুভব করার সুযোগ দিতে পারে বিপুল বইয়ের সংস্পর্শ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, হতাশামুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল, বিবেকবোধসম্পন্ন একেকটি আলোকসন্তানের জন্ম দিতে পারে তার কোমল কচি বয়সের ‘সোনারকাঠি-রুপোরকাঠি’, ‘রাক্ষস-খোক্ষস’, ‘কচ্ছপ-খরগোশ’ কিংবা ‘বাঘ-শেয়াল’-এর মতো গল্পগুলোই। তাকে এক স্বপ্ন সম্ভাবনার জগতে হাতছানি দিয়ে ডাকতে পারে গল্পগুচ্ছ, ফেলুদা, ব্যোমকেশ, হ্যারি পটার, ঘনাদা এবং পাগলা দাশুরা।
২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস। এদিনে তাই ঈশ্বরী পাটনীর কাছে ঋণস্বীকার করে বলি, আমার সন্তান যেন থাকে বই হাতে। বই হাতে পথচলা মানে একশ মাণিক মুঠোয় পুরে নেয়া।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। প্রধান উদ্যেক্তা, ইনোভেটর বইপড়া উৎসব।