বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মেহেরপুর আমবাগান পরিণত হয় ‘বঙ্গভবনে’

  •    
  • ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ১৭:৩৯

১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিব নগরে শপথগ্রহণ করে, যেখানে দেশি-বিদেশি অতিথি ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। মেহেরপুর আমবাগান সেদিন যেন পরিণত হয়েছিল বঙ্গভবনে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা অনেক আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য দিন ১৭ এপ্রিল। ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মেহেরপুরের আমবাগানে শপথগ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন এমএজি ওসমানী। মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত এই সরকার গঠিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে। তবে এ ভূখণ্ডে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার ছিল প্রায় দুই যুগের প্রস্তুতি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট দিয়েছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের মতোই তিনি প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা প্রদর্শন করতে পারেন, দূরদর্শিতা দেখান এবং অপেক্ষা করেন উপযুক্ত সময়ের। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন যখন স্থগিত হয়ে যায়, স্পষ্ট হয়- স্বাধীনতা ঘোষণার সময় এসে গেছে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঘোষণা দেন- এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ অধিবেশন শুরু হয়।

উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র ৭ কোটি বাঙালির ওপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধের ঘোষণা করত, তবে আমরা সে যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করলো। তখন বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।... দেশবাসী জানেন, একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল।’

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালেক ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ২৫ মার্চ প্রায় মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইট প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য প্রায় এক কিলোমিটার অতিক্রম করার পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া আর্মির প্রথম কলাম ফার্মগেটের কাছে প্রথম বাধার সম্মুখীন হয়। বড় একটি গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের শত শত কর্মী জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল। জেনারেল টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের তেজোদীপ্ত স্লোগান শুনতে পাই।

‘ডেভিড লোসাক পাকিস্তান ক্রাইসিস গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯) লিখেছেন, প্রথম গুলির শব্দ যখন শোনা গল, তখনই শেখ মুজিবের কণ্ঠ ভেসে এলো। এটা ছিল অবশ্যই পূর্বে রেকর্ডকৃত বার্তা। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। [উইটনেস টু সারেন্ডার, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫]

টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৭ মার্চ লিখেছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক সাময়িকী ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল- পোয়েট অব পলিটিক্স, রাজনীতির কবি। এতে লেখা হয়, গত সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, তখন তার কোনো কোনো সমালোচক বলল- কট্টর সমর্থকদের চাপের কাছে তিনি নতিস্বীকার করেছেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে মুজিব নতুন বাঙালি ‘জাতির’ যুদ্ধকালীন নেতায় পরিণত হয়েছেন। আর এটাই বাঙালি জাতির জন্য তাঁর আজীবন লড়াইয়ের পুরস্কার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট দিয়েছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের মতোই তিনি প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা প্রদর্শন করতে পারেন, দূরদর্শিতা দেখান এবং অপেক্ষা করেন উপযুক্ত সময়ের। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন যখন স্থগিত হয়ে যায়, স্পষ্ট হয়- স্বাধীনতা ঘোষণার সময় এসে গেছে। ৭ মার্চ ঘোষণা দেন- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

১৯৭২ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনালের সাংবাদিক আমির তাহেরিকে টিক্কা খান বলেন, শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার নিজে শুনেছে। তাই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। [সূত্র: বাংলাদেশ সরকার : ১৯৭১-১৯৭৫- এইচ টি ইমাম, পৃষ্ঠা ৬৪]

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রিসার্চ স্টাডি (ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ) ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারত-পাকিস্তান সংকট বিষয়ে পূর্ববর্তী এক বছরের ঘটনার সারসংক্ষেপ করে লিখেছে- ‘২৬ মার্চ, ১৯৭১- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার কথা প্রচার করছে। বেতার কেন্দ্র বলছে- শেখ মুজিবুর রহমান সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করেছেন- ‘সমগ্র বাংলাদেশের ওপর থেকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক প্রেসিডেন্টের ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেল। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠল ইয়াহিয়া খান। শুরু করল হত্যাযজ্ঞ।... পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী টেলিফোনে ইস্টবেঙ্গল রাইফেলস (বর্তমান বিজিবি) পিলখানা ফাঁড়িতে স্বাধীনতার ঘোষণা ও যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া হলো ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে।’ [ইত্তেফাক, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৯৭]

১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিব নগরে শপথগ্রহণ করে, যেখানে দেশি-বিদেশি অতিথি ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। মেহেরপুর আমবাগান সেদিন যেন পরিণত হয়েছিল বঙ্গভবনে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা অনেক আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

শপথ গ্রহণের পর পরই বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীকে আরও সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করে। যুব শিবির ও শরণার্থী শিবির থেকে মুক্তি বাহিনীর সদস্য সংগ্রহ এবং তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্রসজ্জিত করে রণাঙ্গনে প্রেরণ, স্থল-নৌ-বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে সশস্ত্র বাহিনী গঠন, নদী-সমুদ্রে পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা পরিচালনার জন্য নেভাল-কমান্ডো দল গঠন, মুক্ত বাংলাদেশ পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা- সাদামাটা কয়েকটি ভবনে অবস্থান করে কত দায়িত্ব পালন করে এ সরকার।

২৫ মে চালু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেদিন ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু ছিল এ কেন্দ্রে, যার শিল্পী-কলাকুশলীসহ সব কর্মী ছিল বাংলাদেশের নাগরিক- বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশ সরকার সে সময় নিজস্ব ডাকটিকিট প্রকাশ করে, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য গঠন করে পরিকল্পনা সেল।

ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া প্রায় এক কোটি বাংলাদেশের নাগরিকের থাকা-খাওয়া-চিকিৎসার জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সংগঠিত করার জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তর এবং ব্রিটেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। সদ্য স্বাধীন দেশটির স্বীকৃতি আদায়ে চলে কূটনৈতিক তৎপরতা। নানা দেশের পার্লামেন্টে দাবি ওঠে- বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান কর। পাকিস্তানের কাছে দাবি জানানো হয়- বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ কর। জননন্দিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দাও।

বাংলাদেশের সে সময়ের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়রা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বধ্যভূমি এলাকা পাড়ি দিয়ে ভারতের মাটিতে গিয়ে গঠন করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, কাজী সালাহউদ্দিন, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, শেখ আশরাফ আলী, সুভাস চন্দ্র সাহা- ফুটবলকে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের হাতিয়ারে পরিণত করে। প্রতিটি খেলায় ভারতের নাগরিকরা দলে দলে হাজির হয়ে উৎসাহ দেয়, ধ্বনি তোলে জয় বাংলা।

বাংলাদেশের একদল শিল্পী ভারতের বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মুক্তির গান-এর মতো অনন্য চলচ্চিত্র বাংলাদেশের শিল্পীদের অনুষ্ঠানকে ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে।

বিশ্ববরেণ্য শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, আলী আকবর খান ১ আগস্ট (১৯৭১) নিউইয়র্ক শহরের মেডিসন স্কয়ারে আয়োজন করেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। তারা গণহত্যা বন্ধের দাবি তুলেছেন। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে বলেছেন বিশ্ববাসীকে।

খালি গায়ে, খালি পায়ে লুঙ্গি পরা মুক্তিবাহিনী রণাঙ্গনে- গ্যারি জে ব্যস ‘দি ব্লাড টেলিগ্রামে’ এভাবেই লিখেছেন। তারা মৌসুমী বৃষ্টিতে থেকেছে আকাশের নিচে। এক থালায় পাঁচ-ছয় জন খেয়েছে। এরপরও শত্রু মোকাবিলায় তারা ছিল সংকল্পবদ্ধ। জুলাইয়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কমপক্ষে ১৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছু স্বাভাবিক, এটা দেখাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলাইয়ের শেষ দিকে ঢাকা সফরের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনী বিপজ্জনক হতে থাকায় সব পরিকল্প ভণ্ডুল হয়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক সাময়িকী ১৯ জুলাই, ১৯৭১ তারিখ লিখেছে- আনুমানিক ৩০ হাজার গেরিলা যোদ্ধাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাকিস্তান বাহিনীর কৌশল কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সর্বত্রই তাদের জন্য হতাশাজনক চিত্র। মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি লোককে উজ্জীবিত করতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিটি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড বাঙালিকে প্রতিরোধের শক্তি জোগায়।

সিদ্দিক সালেক লিখেছেন, মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির সংখ্যা ক্রমে বাড়ছিল। রাজশাহীর রোহনপুর এলাকায় এক বাঙালি কিশোর মুক্তিবাহিনীর সদস্যকে বন্দি করা হয়। তার বুকে স্টেনগান ঠেকিয়ে মেজর ‘আর’ বলেন- মুক্তিবাহিনীর তথ্য না দিলে গুলি করে তোমাকে মেরে ফেলব। ছেলেটি মাটিতে চুম্বন দিয়ে বলে- আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমার রক্তে এ পবিত্র ভূমির স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করবে। [উইটনেস টু সারেন্ডার, পৃষ্ঠা ১০৪]

ড. জিল্লুর রহমান খান লিখেছেন, প্রতিটি বাঙালির মধ্যে অভিনব যে বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজর আসে সেটা হচ্ছে, পাকিস্তানি কারাগারে দুঃসহ বন্দিজীবন কাটানো শেখ মুজিবকে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত প্রেরণার উৎস মনে করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি ক্যারিশমেটিক নেতা শেখ মুজিবের নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৪৯]

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সে ১৩৫ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। প্রথম কোর্সে অংশ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় ৯ অক্টোবর, ১৯৭১ তারিখ।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম গ্রহণ করেন। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কর্নেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বের বহু দেশে দেখা গেছে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে দশকের পর দশক দায়িত্ব পালনের পরও কোনো যুদ্ধে অংশ না নিয়েই তাদের অবসর নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সে অংশগ্রহণকারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ২৬ মার্চের পর থেকেই রণাঙ্গনে শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

প্রথম ওয়ার কোর্সে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান ছিলেন। তারা পাশে পেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে। পিতা রাষ্ট্রপতি কিন্তু শত্রু রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দি, মা এবং দুই বোন ও এক ভাই ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি, কিন্তু শেখ কামাল লড়ছেন রণাঙ্গনে। তার ভাই শেখ জামালও ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের কঠোর পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে যোগ দিয়েছেন মুক্তি বাহিনীতে। বিশ্বে এমন নজির মিলবে না যে!

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর