বৈশ্বিক মহামারি কোডিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাব শিশুদের জীবনেও পড়েছে। নির্যাতন, ধর্ষণ এবং বাল্যবিয়ের মতো ঘটনাগুলো বেড়ে যায় সম্প্রতি। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বাইরেও শিশুদের উপস্থিতি একেবারে ছিল না বললেই চলে। এরপর এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গত এক বছরে সারা দেশে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও বাল্যবিয়ে বেড়েছে।
অবনতিশীল শিশু পরিস্থিতি থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ নয়। অধিকাংশ শিশু-ধর্ষণ পারিবারিক ও নির্যাতনের ঘটনা পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। একইভাবে পারিবারিক কারণেই বাল্যবিয়ে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে।
নির্যাতনের পাশাপাশি এ সময় ভয়াবহ হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ে। ২০২১ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ৮৭টি খবর থেকে, স্কুলগুলো খোলার পর পর ৪৩ হাজার ৫৪টি বাল্যবিয়ের কথাও সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ২০২০ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল ১০১টি শিশু।
নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এমনিতেই বেশি। আর গতবছর এই হার বহুগুণ বেড়েছে। বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে বরগুনায়; ১ হাজার ৫১২টি। এরপর কুড়িগ্রামে ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪ জন। আর কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার নাজিমখাঁ, চাকিরপাশা, ধরনীবাড়ী ও দুর্গাপুর ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের হার বেশি বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলা হয়েছে।
২০২০ সালে এই ইউনিয়নে ৮৭টি বাল্যবিয়ে হয়। অপরদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিয়ে হয়েছে ৬৭ জনের। গত বছরের জানুয়ারিতে ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়েছে এমন বাল্যবিয়ের হার ৫৯ শতাংশ। অন্যদিকে, ইউনিসেফের জরিপে বাল্যবিয়ের এই হার ৫১ শতাংশ। এ কারণে দেশে ১৫-১৮ বছর বয়সিদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার ৫১ থেকে ৫৯ শতাংশের মধ্যে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব সমাজে থেকে যাবে, তার একটি হচ্ছে বাল্যবিয়ের কারণে সৃষ্ট নানা সমস্যা। বাল্যবিয়ে বন্ধে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি বাড়ানো, গণমাধ্যমের সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বাড়াতে হবে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু বাড়বে। সর্বোপরি এসডিজি অর্জনে দেশ পিছিয়ে পড়বে।
৮৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার কারণে কিন্তু এখন কেন বাল্যবিয়ে হচ্ছে কেন, কোন কারণে এর সদুত্তোরও নেই। প্রশাসন চেষ্টা করছে কিন্তু ভালো ফল মিলছে এরকম বলা যাচ্ছে না। দেশের বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের এরকম কারণ ছিল।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রসূতি মায়ের জন্যও যেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে পরিমাণে বেশি পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার এবং পরিবারের লোকদের, বিশেষ করে তার জীবনসঙ্গীর যথেষ্ট মনোযোগ, সেবাযত্ন ও ভালোবাসার প্রয়োজন হয়, সেখানে কিশোরীরা অনাদর, অবহেলায় দিন কাটায়। পুষ্টি দূরে থাকুক, পায় না পরিমাণমতো খাবার। উল্টো বাচ্চা বহন করার মতো কঠিন কাজের সঙ্গে সংসারের দায়িত্বও তার কাঁধে বর্তায়।
অথচ একজন কিশোরীর বাড়ন্ত বয়সে শরীর ও বুদ্ধি বিকাশের জন্য এমনিতেই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের দরকার। কিন্তু বাল্যবিয়ের কারণে দেশের ষাট-পঁয়ষট্টি শতাংশ কিশোরীকে শরীর ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটার সুযোগ না দিয়ে অকালমাতৃত্ব ও সংসারের নানা ধরনের দায়িত্ব পালনের চাপে পিষ্ট করে নারী জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে নিজেরই পরিবার।
এই পঙ্গুত্ব নারীর ক্ষমতায়নের পথে যে মস্ত বাধা, তা যেমন তাদের পরিবার বোঝে না, তেমনি সমাজও বোঝে না। এমনকি বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য যাদের হাতে ক্ষমতা ও দায়িত্ব আছে, তারাও তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না যথাযথভাবে। মেয়েদের এখনও পূর্ণ মানুষই মনে করে কি না অনেকে তা নিয়ে সন্দেহ থাকে তাদের কর্মকাণ্ডে। তাই নারীর ক্ষমতায়ন ধারণাটা তারা মানেন না। যদি বুঝতেন, তবে মেয়েদের বিকশিত না করে বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হতেন না।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টোরাল প্রকল্প বাল্যবিয়েসহ সব ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টি তদারক করছে। প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসকেরা বাল্যবিয়ে নজরদারি করছেন। একেবারে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা এবং জেলাপর্যায়ে এই নজরদারি চলে। এসব ক্ষেত্র থেকে আসা তথ্যে দেখা যাচ্ছে না যে, বাল্যবিয়ে বাড়ছে। সরকারের হেল্পলাইন নম্বরে (১০৯) আসা কলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
এক সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়ে দিয়ে দিয়েছেন বা চিন্তা করছেন এমন মা-বাবার ভাবনা হলো অর্থনৈতিক সংকট আছে সংসারে তাই মেয়ের বিয়ে দেয়ার সুযোগ থাকলে দিয়ে দেয়াই ভালো। বেশির ভাগ বাবা-মা এলাকায় বিদেশ থেকে আসা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। আর এ সময় তা পেয়েও যাচ্ছেন। আর বাল্যবিয়ে দিলেও এ সময় প্রশাসন তাতে বাধা দিতে পারবে না বলেও মনে করছেন তারা। ৮৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বনেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে নির্মূলের অঙ্গীকার করেছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি বেড়ে যাওয়ায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, নবজাতক মৃত্যু, শিশু পুষ্টি, শিক্ষা, উন্নয়ন দুষ্টচক্রের মতো ঘুরতে থাকে। বাল্যবিয়ে দেয়ার প্রবণতা রয়েছে, এমন পরিবারগুলো মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে চায় না। মেয়েকে তারা ক্ষণস্থায়ী অতিথি মনে করে।
সরকার উপবৃত্তির ব্যবস্থা রেখেছে বলে মেয়েরা পড়তে পারছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে উপবৃত্তির চেয়ে যৌতুক প্রাধান্য পেতে থাকে। গ্রামে খুব শোনা যায় যে, অল্প বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুক লাগে না। বয়স বাড়লে যৌতুকের পরিমাণও বাড়তে থাকে। যদিও মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পরেও যৌতুক চেয়ে নির্যাতন কিংবা বাবার বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার উদাহরণই বেশি।
বাল্যবিয়ের সঙ্গে এগুলো সত্যিই দুষ্টচক্রের মতো ঘুরতে থাকে। অল্প বয়সে বিয়ে হলে মা হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েটির নিজস্ব মতামত নেয়ার অধিকার থাকে না। বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার পেছনে এমন ঘটনার প্রভাব যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বলতে হবে। মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করুক বা মা-বাবা বিয়ে দিক সবই তো বাল্যবিয়ে। উত্তর একই বাল্যবিয়ের কারণ নির্মূল হচ্ছে না। সরকারের উচিত বাল্যবিয়ের ওপর জরিপ চালিয়ে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা সাজানো। নইলে সাফল্য আসবে না। আইন অনুসারে বাল্যবিয়ে হলে যিনি বিয়ে পড়াবেন এবং যে বাবা-মা বিয়ে দেবেন, তাদের শাস্তির বিধান আছে।
বাল্যবিয়ে নিরোধ বিধিমালা, ২০১৮ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক বিয়ে বা শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা ঘটলে ধর্ষক বা অপহরণকারীর সঙ্গে বিয়েও দেয়া যাবে না। এসব বার্তা মানুষের কাছে কতখানি পৌঁছাচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আদালতে গিয়ে আবেদন করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই কমিটিকে সংগ্রহ করতে হবে। তাহলে অপব্যবহারের চিত্রটি পাওয়া যাবে। মামলা জটের মধ্যে এ জাতীয় আবেদন নিয়ে আদালতে যাওয়ার ঝক্কি অভিভাবকেরা নিতে চান কি না, তাতেও সন্দেহ আছে। এর চেয়ে গোপনে বিয়ে দেয়াটাকে তারা সহজ মনে করেন।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী বাড়াতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগ করে যৌন হয়রানি বন্ধ করতে হবে। অপরাধের ঘটনায় বিচার পাওয়ার আস্থা তৈরি করতে হবে, প্রক্রিয়াও সহজ করতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে করোনার মতো দুর্যোগকে বিবেচনায় রেখে কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে এদেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বব্যপী আনুমানিক ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে, আর বাল্যবিয়ের শিকার ১০ লাখ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২ লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অশুভ। করোনা মহামারির কারণে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা করোনার কারণে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বেড়েছে বাল্যবিয়ে। ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদন বলছে, অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে। ১ দশমিক ৯ লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার বঞ্চিত হয়েছে।
কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে (বিশেষত যেখানে সামাজিক সুরক্ষা বলয় সীমিত)। তাই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা ধনী রাষ্ট্রগুলোর থাকলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রগুলো এ বাস্তবতায় কতদূর টিকে থাকতে পারবে, সেটি একটি কঠিন প্রশ্ন। সবাইকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সবার সম্পৃক্ততায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং বাল্যবিয়ে বন্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক