কোনো সুপারস্টার ছাড়াই দুই সপ্তাহে ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলল দ্য কাশ্মীর ফাইলস। এখনও হইহই করে সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্সে চলছে। কাহিনিকার ও পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর এই ফিল্ম বক্স অফিসে ঝড় তোলার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক ও বোদ্ধা মহলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এটির সমর্থনে আসরে নেমেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ভারতীয় সংসদের চলমান বাজেট অধিবেশনের মধ্যে বিজেপি সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘যারা সব সময় মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে সোচ্চার, তারা গত কয়েক দিন ধরে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। দ্য কাশ্মীর ফাইলসকে তথ্যের নিরিখে বিশ্লেষণ করার বদলে শিল্পের নিরিখে বিচার করার জায়গায় তারা এই ফিল্মটিকে কলঙ্কিত করছেন, সুনামহানি করছেন। কেউ সত্যকে সামনে আনছেন, আর সেই সত্যকে কিছু মানুষ স্বীকার করতেই প্রস্তুত নন।' মোদি বলেছেন, 'সত্যকে ঠিকভাবে দেশের সামনে আনতে হবে। এটাই দরকার। যারা মনে করেন এটা ঠিক নয়, তারা আরেকটি সিনেমা বানান। কে মানা করেছে?'
প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের পরেই বিজেপিশাসিত রাজ্য গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও গোয়ায় করমুক্ত করে দেয়া হয়েছে দ্য কাশ্মীর ফাইলস। আধুনিক ভারতের ইতিহাসবিদ, মহাত্মা গান্ধীর জীবনীকার রামচন্দ্র গুহ টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘ফিল্মটির চিত্রনাট্য খুবই বাজে, সত্য বিকৃত করা হয়েছে এবং কাশ্মীর ফাইলস-এর একমাত্র উদ্দেশ্য আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।’
ফিল্মটি নিয়ে যে বিতর্ক, তা নিয়ে আলোচনা করার আগে দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর কাহিনিতে একটু আলোকপাত করা যাক। কৃষ্ণ পণ্ডিত একজন যুবক, যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই নির্বাচন জেএনইউ-এর নির্বাচনের দ্বারা অনুপ্রাণিত। অধ্যাপক রাধিকা মেনন তার পরামর্শদাতা। কৃষ্ণ একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত হওয়ার কারণে বর্তমান শাসকদের কাশ্মীর সম্পর্কিত বক্তব্য অসাড় প্রমাণ করার জন্য একজন আদর্শ প্রার্থী। কৃষ্ণের দাদু পুষ্কর নাথ পণ্ডিত একজন বাস্তুচ্যুত কাশ্মীরি পণ্ডিত, যিনি ডেমেনশিয়ায় ভুগে মারা যান। কৃষ্ণ দাদুর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে কাশ্মীরে যান এবং তাদের পৈতৃক বাড়িতে তার দেহভস্ম ছিটিয়ে দেন। তিনি যখন পৌঁছান, তাকে পাঁচ ব্যক্তি স্বাগত জানায়, যারা তার জন্য অপেক্ষা করছিল: ব্রহ্মা দত্ত, যিনি একজন প্রাক্তন ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবা অফিসার এবং তার স্ত্রী লক্ষ্মী দত্ত; ডা. মহেশ কুমার, যিনি একজন ডাক্তার এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন; একজন অবসরপ্রাপ্ত ডিজিপি, হরি নারায়ণ এবং বিষ্ণু রাম নামে একজন সাংবাদিক।
এদের সবার বয়স ৭০-এর কোঠায়, তারা বৃদ্ধ, ক্লান্ত এবং তিক্ত। তারা সবাই কৃষ্ণের দাদুকে চিনতেন এবং তার অতীত সম্পর্কে জানতেন। কৃষ্ণের কোনো ধারণাই ছিল না যে তার বাবা, মা এবং বড় ভাইকে কাশ্মীরে জঙ্গিরা হত্যা করেছে। রাধিকা মেননের মাধ্যমে তার মগজ এমনভাবে ধোলাই হয়েছে যে তিনি প্রাথমিক সত্যগুলো গ্রহণ করতে অক্ষম। তবে ধীরে ধীরে তিনি তার পরিবার সম্পর্কে সত্যটি আবিষ্কার করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বদলে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে তিনি একটি বক্তৃতায় রাধিকা মেননের বক্তব্যকে সম্পূর্ণরূপে এবং প্রকাশ্যে কঠোর ভাষায় খণ্ডন করেন। তার বাকপটু বক্তব্য শ্রোতাদের বিস্মিত এবং কিছুটা বিব্রত করে।
২০০৩ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় নন্দীমার্গ গণহত্যায় তার দাদুর সামনে জঙ্গিদের হাতে তার মা এবং ভাই-বোনের হত্যার হৃদয়বিদারক দৃশ্য দিয়ে ফিল্মটি শেষ হয়।
আমি ফিল্ম বোদ্ধা নই। তাই এই ফিল্মটি নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষ্য অনুযায়ী 'শিল্পের নিরিখে বিচার করার' দুঃসাহস আমি দেখাব না। তবে একটা উদ্ধৃতি দিতে চাই শিল্পের নিরিখ সম্পর্কে। মুম্বাইয়ের তরুণ চিত্রনাট্যকার দারাব ফারুকী একটি ইংরেজি ওয়েব পোর্টালে লিখেছেন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস প্রকৃতপক্ষে সত্যকে নিপুণভাবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে, সত্যকে চেরি-পিক করে এবং সত্যকে আবেগগতভাবে শোষণ করে। ফলে চলচ্চিত্রটি শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধ সালফিউরিক অ্যাসিড (ভিট্রিওল) এবং ঘৃণার একটি মিশ্রণে পরিণত হয়েছে।
‘সহানুভূতি জাগিয়ে তোলা এবং মানুষকে একত্রিত করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত বিষয় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তবে খুব দ্রুত এটি সত্যিকারের দুষ্ট এবং নৃশংস কিছুতে পরিণত হয়েছে।... আমি বিশ্বাস করি শিল্প বা কারিগরের প্রকৃত কাজ না করে এটিকে শুধুমাত্র প্রচারধর্মী ছবি বানানো হয়েছে। প্রোপাগান্ডার সংজ্ঞা অনুসারে এই ছবিতে তথ্য, যুক্তি, অনুমান, অর্ধ-সত্য বা সরাসরি মিথ্যা প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ছবিটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করে, যা একতরফা এবং সত্যকে আংশিক বা সুবিধাজনকভাবে উপস্থাপিত করেছে।’
আমি প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী দ্য কাশ্মীর ফাইলসকে তথ্যের আধারে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্তৃত্বাধীন পরিবারের পূর্ণ সমর্থন ও আশীর্বাদ পেয়েছে ছবিটি। কারণ ছবিটি হিন্দুদের (কাশ্মীরি পণ্ডিত) ওপর মুসলমানদের অত্যাচারের কথা বলে, সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক প্রচারের যা সারবস্তু। গত তিন দশক ধরে জম্মু-কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীরা রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। হাজারে হাজারে নিরীহ সাধারণ মানুষ, সে হিন্দু হোক বা মুসলমান, খুন হয়েছে। ভয়ে, আতঙ্কে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কয়েক হাজার কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার তাদের বংশানুক্রমিক ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। এসবই কঠিন বাস্তব।
এ ফিল্মে এই বাস্তবতার সামগ্রিক প্রতিফলন নেই। ছবিতে এমন একটিও মুসলিম চরিত্র নেই যিনি সহানুভূতিশীল। প্রতিটি মুসলিম চরিত্র হয় প্রতারক বা খারাপ। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিত সংগ্রাম সমিতির মতে, কাশ্মীরে ৩৫৭ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল।
অন্যদিকে, সরকারি-বেসরকারি সমস্ত রকম পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাজার হাজার মুসলমান নাগরিক সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছে। কেন এই মুসলমানদের খুন করা হয়েছিল, সেই বিষয়টি চলচ্চিত্রে কখনই বলা হয়নি। হাজার হাজার মুসলিম শিশু অনাথ হয়েছে। হাজার হাজার মুসলিম নারী বিধবা হয়েছে। এসবের কোনো উল্লেখ ‘তথ্যের আধারে নির্মিত’ দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এ নেই।
কাশ্মীরে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, সে হিন্দু হোক বা মুসলমান। রিপোর্ট অনুযায়ী, জঙ্গিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধেও নৃশংসতা চালিয়েছে। কাশ্মীরে আটকে পড়া মুসলমানদের পালানোর জায়গা নেই। তারা ছায়ায় লুকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চরমপন্থিদের সহজ লক্ষ্য ছিল। এই অসহায় পরিবারগুলোকে যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার একটিও উল্লেখ নেই এ ফিল্মে।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এ কাশ্মীর উপত্যকার মুসলমান জনতা উপেক্ষিত, কারণ এটি পরিচালকের লক্ষ্যই ছিল না। যে প্রোপাগান্ডা ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, তার জন্য এই বাস্তবতা অসুবিধাজনক এবং অস্বস্তিকর। ফলে মানুষকে উসকানি দেয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে সত্যের একটি ছোট অংশকে সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে সফলভাবে। নিরীক্ষণ ছাড়াই তথ্য পেশ করা হয়েছে বড় পর্দায়। হত্যাকাণ্ডের মাত্রা অতিরঞ্জিত, সম্ভবত এর কারণ অগ্নিহোত্রী মনে করেন ‘গণহত্যা’ শব্দটি শুধুমাত্র সংখ্যার বিষয়।
সুনীল পণ্ডিতা, যিনি উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলা থেকে পালিয়ে এসেছেন জম্মুর উদ্বাস্তু কলোনিতে, তিনি দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে তার আওয়াজ তুলে এটিকে একতরফা গল্প বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি দাবি করেছেন, ছবিটির লক্ষ্য হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ প্রসারিত করা। পণ্ডিতা অভিযোগ করেছেন, ছবিটি সম্পর্কে মতপ্রকাশের পরেই বিজেপি কর্মীদের দ্বারা তাকে হয়রানি ও হুমকি দেয়া হয়েছিল। পণ্ডিতা বলেন, ‘ওরা মাতাল ছিল, আমার বাড়ির বাইরে এসে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে আমার বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমার স্ত্রী দুইবার অজ্ঞান হয়ে যায়, অন্যরা ভয়ে আমাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়নি।’
এ ফিল্মে সত্যকে বিকৃত করে দেখানোর অভিযোগও আছে। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ দ্য কাশ্মীর ফাইলসকে একটি প্রচারধর্মী ফিল্ম বলে অভিহিত করেছেন। এই ফিল্মে কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের পলায়নকালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফারুক আব্দুল্লার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা। তখন জম্মু-কাশ্মীরে ছিল রাষ্ট্রপতির শাসন এবং কেন্দ্রে ছিল বিজেপি সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং-এর নেতৃত্বাধীন সরকার।
জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ একটি ইংরেজি সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে কথোপকথনের সময় বলেছেন, ‘আমরা তৎকালীন রাজ্যপাল (জম্মু-কাশ্মীর) জগমোহন মালহোত্রাকে ভুলতে পারি না, যিনি পণ্ডিতদের বাসে তুলে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমরা আপনাদের দুই মাসের মধ্যে ফিরিয়ে আনব, কারণ আমাকে বিদ্রোহীদের দোষ দিতে হবে, বল প্রয়োগ করতে হবে, যা আপনাদের প্রভাবিত করতে পারে। ৩২ বছর হলো, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা কোথায়? আমি মনে করি না যে আমি এই ঘটনার জন্য দায়ী।’
ফারুক আবদুল্লাহ আরও বলেন,‘সে সময় আমি সেখানে শাসন করিনি। জগমোহন আসতেই হাল ছেড়ে দিলাম। আমি বললাম, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করুন। দিল্লি আমাকে বিশ্বাস করেনি, ওকে (জগমোহন) বিশ্বাস করেছিল। ওর শাসনের প্রথম দিনেই প্রাণ হারায় ৫০ জন। সেখানকার ইনচার্জও উনিই ছিলেন। তিনি কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন? মানুষ যদি সত্য জানতে চায়, তাহলে তাদের কথা বলা উচিত তৎকালীন আইবি প্রধান বা তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বর্তমানে কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের সঙ্গে।’
ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, ‘আপনি যখন একজন সৎ বিচারক বা কমিটি নিয়োগ করবেন, তখন পুরো সত্য বেরিয়ে আসবে। এই ঘটনার জন্য কারা দায়ী তা জানতে পারবেন। ফারুক আবদুল্লাহ দায়ী হলে ফারুক আবদুল্লাহ দেশের যেকোনো কোণে নিজেকে ফাঁসি দিতে প্রস্তুত। আমি বিচারের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু যারা ওই ঘটনার জন্য দায়ী নয়, তাদের দোষারোপ করবেন না।’
এই ফিল্ম কী প্রচারের জন্য তৈরি, তা বোঝা যায় কিছু দর্শক বা শাসক দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়ায়। উত্তর ভারতজুড়ে প্রেক্ষাগৃহে ফিল্মটির বক্স অফিস সাফল্যের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু পুরুষদেরকে মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করার আহ্বান জানানো হচ্ছে এবং ‘মোল্লা কাটে যায়েঙ্গে, রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে’ বলে স্লোগান দেয়া হচ্ছে, আসলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অগ্নিহোত্রী ঘৃণার একটি বড় প্রবহমান স্রোত তৈরি করেছেন।
বিভিন্ন সিনেমা হলের ভেতরে এবং বাইরে, কাশ্মীর ফাইলস-এর দর্শকদের সামনে কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মুসলমানবিরোধী উত্তেজক বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপিং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিম দিল্লির বিজেপি সাংসদ প্রবেশ সাহেব সিং ভার্মার শেয়ার করা একটি ভিডিওতে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে একটি সিনেমা হলে দেয়া তার বক্তৃতায় বলতে শোনা যায়: ‘আমরা যদি ধর্মনিরপেক্ষতা না ত্যাগ করি, তবে কাশ্মীরের পরে কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গেও এর পুনরাবৃত্তি হবে। আমরা দিল্লির দাঙ্গা দেখেছি, যেখানে তাহির হুসেন নেগিকে হত্যা করেছিল।’
একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে উগ্র দক্ষিণপন্থি সংগঠন হিন্দুসেনা নেতা সুশীল তিওয়ারি লখনৌতে সিনেমাটি দেখার পরে হিন্দুদের সতর্ক করে ভাষণ দিচ্ছেন। তার বক্তব্য: ‘হিন্দুরা যদি এখনও না জাগে, তাহলে ৩০ বছর আগে কাশ্মীরে যা হয়েছিল, ১৫ বছর পরে সারা দেশে তার পুনরাবৃত্তি হবে।’
সাম্প্রদায়িক ঘৃণাত্মক ভাষণের জন্য পরিচিত দিল্লির হিন্দুত্ববাদী যুব কর্মকর্তা রাকেশ সিসোদিয়া, জাতীয় রাজধানীসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে প্রজেক্টরে দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখাচ্ছেন। তার ফেসবুক পৃষ্ঠায় তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে উত্তেজক পোস্ট দিয়েছেন, যে পোস্টে বলা হয়েছে: ‘কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তার প্রতিশোধ নেয়া উচিত, আপনার আশপাশের মুসলমানরা এই মুহূর্তে অল্প সংখ্যায়, কিন্তু তাদের সংখ্যা বাড়লে সর্বত্র এই পরিস্থিতি তৈরি হবে। (মুসলিমদের থেকে) সাবধান।’
এ রকম অসংখ্য ভিডিও সিনেমা হল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, আক্রমণাত্মক যুবকেরা উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে শারীরিক সহিংসতা এবং মুসলমানদের বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছে। এই ভিডিওগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিজেপি নেতাদের দ্বারা জনপ্রিয় হয়েছে, সম্ভবত এটা বোঝানোর জন্য যে ছবিটির সাথে সাধারণ হিন্দুরা একাত্মতা অনুভব করছেন। বক্স অফিসের থেকেও অনেক অনেক বড় এই সাফল্য। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উচ্ছেদ, রক্তপাত নিয়ে ছবি তৈরি করার মূলে ধর্মীয় বিভাজনকে আরও ব্যাপক করে তোলার যে ভাবনা, তা সফলভাবে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রী।
ইতিহাস যারা চর্চা করেন, তারা হয়তো জানবেন হেলেন বার্থা আমালি ‘লেনি’ রিফেনস্টাল-এর কথা। তিনি ছিলেন একজন জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক, ফটোগ্রাফার এবং অভিনেত্রী। তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন নাৎসি প্রচারে তার প্রধান ভূমিকার জন্য। ১৯৩০-এর দশকে তিনি নাৎসি প্রচারমূলক চলচ্চিত্র ট্রায়াম্ফ ডেস উইলেন্স (‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’) এবং অলিম্পিয়া পরিচালনা করেন।
দুটি ছবির বিষয়বস্তুর জন্য নয়, রিফেনস্টাল বিশ্বব্যাপী মনোযোগ ও প্রশংসা পেয়েছিলেন চলচ্চিত্র দুটিকে ব্যাপকভাবে সবচেয়ে কার্যকর এবং প্রযুক্তিগতভাবে উদ্ভাবনী প্রচারমূলক চলচ্চিত্র হিসেবে তৈরির জন্য। নুরেমবার্গে ৭ লাখ সমর্থকের অংশ নেয়া নাৎসি পার্টির কংগ্রেসে ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইলকে(১৯৩৫) সর্বকালের সেরা তথ্যচিত্রগুলোর একটি বলা হয়। এটি শুধু সিনেমায় নয়, প্রচারের ক্ষেত্রেও একটি মাস্টারক্লাস, কারণ এটি জার্মান পুরুষত্বের আদর্শ সংস্করণ– স্বর্ণকেশী, নীল চোখের, সুঠামদেহী এবং নাৎসি জার্মানির অনবদ্য সাংগঠনিক দক্ষতা দেখায়।
স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তনে দলের সম্মেলনে নয়, দলীয় সাংসদদের সভায় নরেন্দ্র মোদি এই ছবির বিরোধীদের তিরস্কার করেছেন। সংবাদমাধ্যম মোদির এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে কোটি কোটি মানুষের কাছে।
আর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক অলডাস হাক্সলি বলেছিলেন, ‘প্রোপাগান্ডা জনপ্রিয় অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিক আন্দোলনকে শক্তি ও দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু এটা এই আন্দোলনগুলো তৈরি করতে খুব বেশি কিছু করে না। প্রচারক এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ইতোমধ্যে বিদ্যমান একটি ধারাকে প্রবাহিত হতে সাহায্য করেন। যে দেশে জল নেই, সেখানে সে নিরর্থক খনন করে।’
ভারতে খালবিল-নদীর অভাব নেই। বোঝা যায় একটা দ্বিতীয় শ্রেণির ফিল্মের ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা।