ফেসবুকে একটি সুইসাইডাল নোট ভাইরাল হয়েছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সি আশামনি নিজেকে হত্যা করার আগে বাবা-মাকে উদ্দেশ করে লিখে রেখে গেছে তার মৃত্যুর কারণ। কাঁচা হাতে ভুল বানানে মেয়েটি লিখেছে- ‘‘মা আমার সাথে ওয়াহাব চেয়ারম্যান’এর বাতিজা আজকে দিন এক রুমে কাটাইছে। পারলে ক্ষমা করো। যদি কোনো বিচার করো ছেলেটার নাম তামিম আহমেদ শপন খান। মা বাবা তোমরা ভালো থেকো। আমারে ভুলে যেও। আমি বেচে থাকলে তোমাদের সমমান শেষ হয়ে যেতো। বাবা মা আবার বলতেছি ভালো থেকো। বাবা মা ভালো থেকো। গুড বাই সোনা বাবা মা।” এই চিঠিটা পড়ার পর থেকে আমার আসলে মাথা ঠিকঠাক মতো কাজ করছে না। বেদনায় হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছে। আশামনির বাবা-মার কথা ভেবে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। অতটুকু মেয়ে সে তার বাবামার সম্মানের কথা ভেবে নিজের জীবন দিয়ে দিল! এইটুকু চিঠিতে সে তিনবার বাবা-মাকে ভালো থাকার কথা বলেছে। আরে বোকা মেয়ে তুমি জীবন দিলে বাবা-মা ভালো থাকবে কীভাবে? মেয়েটি বলেছে, তাকে যেন বাবা-মা ভুলে যায়। কিন্তু হায়, পৃথিবীর কোনো বাবা-মা কি কখনও সন্তানকে ভুলে যেতে পারে।
আশামনির বাবা-মায়ের কথা পরে, আমিই কবে মাথা থেকে এই সুইসাইডাল নোটটি ঝেড়ে ফেলতে পারব জানি না। নোটটি পড়ে আমি বেদনার্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রদ্ধ, রাগান্বিত। মানবাধিকারের ধারণা ঝেড়ে ফেলে ইচ্ছা করছে, ছুটে গিয়ে সেই চেয়ারম্যানের ভাতিজাকে পিটিয়ে আসি। আশামনির জন্য আমার সমস্ত ভালোবাসা এবং রাগ। আশামনি তো আশা বাঁচিয়ে রাখবে, লড়াই করবে, জীবন দেবে কেন? আত্মহত্যায় তো কোনো সমাধান হলো না রে মা!
পুলিশ অভিযুক্ত ধর্ষক তামিমকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু কি বিচার হবে, কবে হবে, চেয়ারম্যান বিচারে কতটা প্রভাব বিস্তার করবেন; এসব নিয়ে আমার ঘোরতর সংশয় আছে। ধর্ষণের বিচারের কঠোর আইন আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ধীরগতির বিচার ব্যবস্থা, আদালতে ধর্ষণ প্রমাণের নানা প্রতিকূলতায় বিচার আর হয় না। প্রতিদিন পত্রিকায় ধর্ষণের খবর থাকে, তাহলে তো প্রতিদিন বিচারের খবরও থাকার কথা। কিন্তু বিচার বা রায় কিংবা সাজা বাস্তবায়নের খবর আমরা পাই-ই না। তাই আশামনিরা বাবা-মায়ের সম্মান বাঁচাতে মরে যায়।
ভিকটিমের পয়েন্ট থেকে বিবেচনা করলে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ ধর্ষণ। এমনকি আমার কাছে মনে হয়, হত্যার চেয়েও ভয়ংকর। মানবজীবন সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ কোনো কিছুর বিনিময়েই জীবন ফিরে পাওয়া যায় না। তাই হত্যাই সবচেয়ে বড় অপরাধ। কিন্তু খুন হয়ে যাওয়ার পর ভিকটিমের পরিবার-বন্ধু, স্বজনদের কষ্ট হবে; কিন্তু ভিকটিমের তো আর কিছু যাবে আসবে না। সে তো কিছু জানতেই পারবে না। কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে ঘটে উলটো ঘটনা। যতদিন বাঁচবেন, তাকে দিন কাটাতে হবে ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন আর দীর্ঘ মানসিক ট্রমা নিয়ে। আমি আপনি যতই বলি, যতই সান্ত্বনা দেই, যতই বিচার হোক; ধর্ষিতার মন থেকে অপমান, অমর্যাদার গ্লানি, বেদনা কখনোই মুছে যাবে না।
একজন নারীকে ধ্বংস করার সবচেয়ে সহজ অস্ত্র ধর্ষণ। একজন ধর্ষিতা নারী জীবনভর বার বার মরেন। সড়ক দুর্ঘটনায় একটা পা হারিয়ে গেলেও মানুষ সে কষ্ট ভুলে যেতে পারে। কিন্তু ধর্ষণের গ্লানি, ধর্ষণের বেদনা তাকে বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর। ধর্ষণে বেঁচে যাওয়ার পর তাকে প্রতিদিন মানসিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়। এই ভয়ে অনেকেই ধর্ষণের খবরটি চেপে যান। নিজে নিজেই দগ্ধ হন গ্লানিতে। সইতে না পেরে আশামনির মতো কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেন। ধর্ষককে আদালত পর্যন্ত নিতে ভিকটিমের দুরন্ত সাহস আর দৃঢ় মনোবল থাকতে হয়, লাগে পরিবার ও চারপাশের সহায়তা। কিন্তু অনেকের মনোবল ততটা দৃঢ় থাকে না। ধর্ষণই যে কারো মনোবল শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। আর পরিবার এবং চারপাশের সহায়তা তো পানই না, ঘটে উলটো ঘটনা।
তারপরও যারা সাহস করে বিচার চাইতে যায়, তাদের আসল গ্লানিটা শুরু হয় তখন। প্রথমে হাসপাতালে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে হয়, তারপর পুলিশের কাছে ধর্ষণের খুটিনাটি বিবরণ দিতে হয়। অভিযোগ যদি আদালত পর্যন্ত যায়, তাহলে প্রকাশ্য আদালতে আইনজীবীর অশ্লীল জিজ্ঞাসাবাদে বার বার ধর্ষিত হতে হয়। এই দীর্ঘ দুর্ভোগ সইবার মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না।
আমাদের আইনটাই এমন ধর্ষকের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। চেষ্টা করা হয় ধর্ষিতাকে নষ্টা, চরিত্রহীনা প্রমাণের। আর এটা প্রমাণ করতে পারলেই যেন জায়েজ হয়ে যায় ধর্ষণ। কিন্তু মেয়েটি যৌনকর্মী হলেও, এমনকি আপনার বিয়ে করা স্ত্রী হলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেকোনো সম্পর্ক অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশে যে ব্যক্তি ধর্ষণ করে, তার পক্ষে হাজার যুক্তি- বয়সের দোষ, পোলাপান একটু-আধটু এমন করেই, মেয়েটা কেন অত রাতে অমন পোশাকে বাইরে এলো, মেয়েটা কেন হেসে কথা বললো, মেয়েটা কেন ফিরে তাকাল।
খলের কখনও ছলের অভাব হয় না। নেকড়ে ভেড়াটাকে খাবে। ব্যস, এর জন্য যুক্তির অভাব হবে না। ধর্ষণ যতটা যৌনতার কারণে ঘটে, তারচেয়ে বেশি ঘটে পুরুষের ক্ষমতার প্রকাশ করতে। আশামনির ধর্ষক তামিম যেমন ওয়াহাব চেয়ারম্যানের ভাতিজা। এই চেয়ারম্যানের ক্ষমতায় তার ভাতিজা রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করবে, সুযোগ পেলে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করবে। কারণ তারা জানে, চাচার ক্ষমতা তাদের ঢাল হয়ে রক্ষা করবে। আশামনি মরে গেছে বলে, তবুও বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। বেঁচে থাকলে হয়ত আমরা জানতেও পারতাম না। মেয়েটি হয়ত মামলা করারই সাহস পেত না। মামলা করলেও সাক্ষির অভাবে বিচার হতো না।
এই সমাজে ধর্ষকরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর ধর্ষিতার জন্য এই পৃথিবীটা হয়ে যায় নরকসময়। অবিবাহিত হলে তার আর বিয়ে হবে না। বিবাহিত হলে সংসার ভেঙে যাবে। এই মেয়েগুলোকে একটু সুরক্ষা দেয়ার আশায় আমরা তাদের নাম প্রকাশ করি না, ছবি দেখাই না। কিন্তু তাতে কাজ হয় সামান্যই। এলাকার সবাই চিনে ফেলে তাকে। মেয়েটি হেঁটে গেলে হাজার পুরুষের চোখ তাকে বার বার ধর্ষণ করে। নিজেরা মেয়েটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে রসালো আলাপ করে।
জামালপুরের মেলান্দহের স্কুলছাত্রী আশামনি নিশ্চয়ই জানত, বেঁচে থাকার গ্লানিটা। তাই সে মরে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছে।
আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে ধর্ষণ বন্ধ হবে না। একটা বিষয় পরিষ্কার করতে হবে, ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতার কোনো দায় নেই, দোষ নেই। এই ঘটনায় অপরাধ শুধু ধর্ষকের। কিন্তু গ্রামে দেখেছি দুজনকে দেখেই লোকজন হাসে। ধর্ষিতাকে দেখে হাসে অশ্লীল হাসি, আর ধর্ষককে দেখে হাসে প্রশ্রয়ের হাসি। গ্রামে সবচেয়ে ঘৃণার কাজ হলো গরু চুরি করা। আর ধর্ষণ যেন কোনো অপরাধই নয়। আহারে পোলাপান মানুষ করে ফেলেছে, বয়সের দোষ মিটমাট করে দাও, বিয়ে দিয়ে দাও।
সারা দেশে যত ধর্ষণের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। অনেকেই সামাজিকতার ভয়ে, লজ্জায় চুপ করে থাকেন। অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের মুখ বন্ধ রাখেন। অনেক সময় সামাজিকভাবে মিটিয়ে ফেলেন। আর পরিবারের ভেতরে মামা-চাচা, খালু-কাজিন, প্রতিবেশীর দ্বারা যে কন্যা শিশু বা মেয়েরা কত ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কেউ জানতেও পারে না। এমনকি কন্যাশিশুরা অনেক সময় ভয়ে কাউকে কিছু বলেও না। অনেক সময় বললে, তাকেই উলটো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়।
আমি এমন একটা দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন সব ভালোবাসা, মমতা নিয়ে সবাই ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াবে। আর ধর্ষকের প্রতি থাকবে প্রবল ঘৃণা। ধর্ষক এবং তার পরিবারকে এমনভাবে ঘৃণা করতে হবে, যেন তাদের বেঁচে থাকাটাই দায় হয়। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে যেন ধর্ষিতা নয়, ধর্ষক জীবন দিতে যায়। কিন্তু ধর্ষিতাকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হবে না। ধর্ষিতা যেন তার স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যেতে পারে।
ধর্ষিতার লেখাপড়া-সংসার, ক্যারিয়ার কোথাও যেন কোনো সমস্যা না হয়। সমাজে যেন তিনি সাহসী নারীর মর্যাদা পান। ধর্ষিতা যেন তার পরিচয় না লুকিয়ে জোর গলায় বলতে পারে, লজ্জা আমার নয়। আমি মাথা উঁচু করে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটব। তুই ধর্ষক, তুই অপরাধী, লজ্জা তোর!
আমি জানি তেমন দিন আসতে অনেক সময় লাগবে। তবু আমাদের লড়াইটা চালাতে হবে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বিএনপি আমলে ধর্ষণের শিকার পূর্ণিমা টেলিভিশন টক শো’তে এসে কথা বলেছেন। ধর্ষণের পর নিজের দুঃসহ জীবনের বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, যারা ধর্ষণ করেছে লজ্জাটা তো তাদের, আমাদের লজ্জা হবে কেন? এভাবেই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে হবে।
ধর্ষকদের ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে ধর্ষিতাকে বসাতে হবে মর্যাদার আসনে। তার পাশে দাঁড়াতে হবে, সাহস দিয়ে বলতে হবে, মেয়ে তুমি ভয় পেও না, লজ্জা পেও না। দোষ তোমার নয়, দায় তোমার নয়। এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। একটি দুর্ঘটনা যেন তোমার জীবন থামিয়ে না দেয়। মেয়ে তুমি এগিয়ে যাও। আশামনিরা যেন বেঁচে থেকে আশার প্রদীপ জ্বালাতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক