বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লাভের কৃষি ও লোকসানের কৃষক

  •    
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৪:০৮

ছোট, মাঝারি কৃষক চড়া দামে কৃষি উপকরণ কেনে আর চোখের জলে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে। ধনী, শিল্পের মালিকদের ঋণ পেতে সমস্যা নেই, ঋণ শোধ না করলেও সমস্যা নেই কিন্তু নিজেরা পিছিয়ে পড়ে দেশকে বাঁচিয়ে রাখছে যে কৃষক তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে গেলে টাকার সংকট। সারে ভর্তুকি না দেয়ার জন্য নাকি চাপ আছে।

মাঘের শেষের বৃষ্টিতে আলুচাষিদের মাথায় হাত, সবজি চাষিদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ, এ রকম খবর আমরা দেখেছি। কিন্তু পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা উত্তরবঙ্গের খবর নিলে বোঝা যাবে। জয়পুরহাট থেকে কৃষক নেতা ওয়াজেদ পারভেজ জানালেন, আলুর মণ ২শ থেকে ২শ ৫০ টাকা। কী করব আমরা? এ রকম প্রাকৃতিক বিষয় আর মানবসৃষ্ট দুর্ভোগ বাংলাদেশের কৃষকদের যেন পিছু ছাড়ছেই না। কিন্তু কৃষিপ্রধান এবং কৃষক অবহেলাকারী বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কৃষিকে বাদ দিয়ে কি ভাবা যাবে?

রপ্তানি আয় দেখিয়ে যারা অর্থনীতির শক্তি বোঝাতে চান তারা কি বুঝতে পারছেন না, ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির দেশে ৮০ শতাংশ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। যার ভিত্তি সস্তা ও অদক্ষ শ্রমশক্তি আর বিদেশের বাজার। করোনা দেখিয়েছে এই খাত কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। আর করোনা এটাও দেখিয়েছে যে কৃষির ওপর ভরসা করা ছাড়া উন্নয়ন কতটা ভঙ্গুর। ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি এখনও কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

দেশের প্রধান খাদ্য ভাত-মাছ, ডিম ও মাংসে স্বনির্ভর হওয়ার ব্যাপক ঘোষণা সত্ত্বেও এখনও দেশের ৭৩ শতাংশ মানুষ দৈনিক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর খাবার পায় না। খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও দেশের সাধারণ মানুষের বেশ বড় একটা অংশ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। কৃষিতে বিনিয়োগ না বাড়ালে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে না। এসব কথা বললে সরকারি দল হৈ হৈ করে উঠে বলবে যে, আপনারা সরকারের উন্নয়ন দেখেন না। কিন্তু জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ভার্চুয়াল সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এই সংলাপে আরও বলা হয়েছে, দেশের ৩২ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষিখাতে মাথাপিছু বিনিয়োগ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একেবারে নিচের সারিতে।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সংলাপে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরতে গিয়ে এফএও বাংলাদেশের বাজার ও বাণিজ্যবিষয়ক পরামর্শক মনিরুল হাসান বলেছেন, নেদারল্যান্ডস কৃষি খাতে বছরে মাথাপিছু ৩১৪ ডলার, ভারত ৩৪ ডলার ও মিয়ানমার ২৬ ডলার বিনিয়োগ করে। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১৬ ডলার বিনিয়োগ করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ধানের উৎপাদন ৪ হাজার ৭৩৫ কেজি। আর চীনে তা ৭ হাজার কেজির বেশি।

অপরদিকে দেশে কৃষিজমি কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যা বাড়ছে। তাই খাদ্যনিরাপত্তাকে টেকসই করতে হলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একরপ্রতি ধানসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আলোচনায় এটাও উঠে এসেছে যে, দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও এখনও গরিব মানুষ মূলত ভাত থেকে তাদের পুষ্টিচাহিদার বড় অংশ মেটায়। তাই ভাত কম খান বললেই চলবে না, ভাতের উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টিকর ও বহুমুখী খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।

উৎপাদন বাড়ানোর উপায় কি আছে? দেশের ৭৮ লাখ হেকটর আবাদি জমির মধ্যে ৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা যায়। এক হেক্টর মানে সাড়ে সাত বিঘা। বিঘায় গড়ে ২০ মণ ধান উৎপাদন ধরলে হেক্টরে ৫ টনের বেশি উৎপাদন হয়। তাহলে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭৫ লাখ টন ধান উৎপাদন সম্ভব। আমন মৌসুমে দেড় কোটি টন আর আউস মৌসুমে ৫০ লাখ ধান উৎপাদন তো সহজেই করা সম্ভব।

তাহলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টন ধান উৎপাদন করতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ধান থেকে ৬৬ শতাংশ চাল উৎপাদন হয়। সে হিসেবে ৩ কোটি ১০ লাখ টন চাল তো উৎপাদিত হতেই পারে। আমরা ভাত বেশি খাই বলে কৃষিমন্ত্রী যতই কটাক্ষ করুন না কেন তার হিসাবেই তো দিনে গড়ে ৪০০ গ্রাম চাল খাই আমরা। ছোট শিশু থেকে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ সবাইকে এই হিসাবে ধরলে বছরে চাল লাগার কথা ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। তাহলে খাদ্যঘাটতি কেন, চাল আমদানিতে এত ব্যস্ত হতে হয় কেন, চালের বাজার এত চড়াইবা হয় কী করে?

মন্ত্রী বলেছেন, সারের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে, ফলে সারবাবদ বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে লাগবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকিতে লেগেছিল ৭ হাজার ৭শ ১৭ কোটি টাকা। সে বছর ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ৫শ কোটি টাকা।

বাকি টাকা কোথায় গিয়েছে জানা যায় না। এই প্রথম কোনো মন্ত্রী বললেন, এ বছর ভর্তুকি খাতে বাজেট মাত্র ৯ হাজার ৫শ কোটি টাকা। মাত্র কথাটা এর আগে কখনও শোনার ভাগ্য হয়নি জনগণের। মন্ত্রী বলেছেন, সারের জন্য তার আরও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেটে এই ভর্তুকি কি অতিরিক্ত কোনো অর্থনৈতিক বোঝা?

ডিজেলের দাম বাড়ানোতে সরকারের লাভ হলেও কৃষকের খরচ গেছে বেড়ে। উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা বলেছে, বোরো মৌসুমে এক হেক্টর জমিতে ১০ থেকে ১৫ বার সেচ দিতে হয়। এতে প্রয়োজন হয় ৪৫-৫০ লিটার ডিজেল। এই হিসাবে প্রতিহেক্টরে বোরো চাষে ডিজেলের বাড়তি দামে কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হবে ৭শ টাকার বেশি। তাদের মতে, তেলের দাম বাড়ায় ধানের চাষ করাই দুষ্কর হয়ে গেছে। হালচাষের খরচ বেড়ে গেছে। শ্যালো মেশিনে সেচের খরচ বেড়ে গেছে। খরচ বেড়েছে বলে কৃষক কি তাহলে ধান চাষ কমিয়ে দেবেন?

ডিজেলসহ সব উপকরণের দাম বাড়ায় ১ একর জমিতে বোরো আবাদ করতে গত বছরের চেয়ে অতিরিক্ত ২-৩ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। তেলের দাম বাড়ায় একরপ্রতি সেচখরচ ৪শ টাকা, ট্রাক্টর দিয়ে চাষে ৩শ টাকা ও মাড়াইয়ে ৩শ টাকার খরচ বেশি পড়েছে। সারসহ অন্য উপকরণের দামও চড়া। তাই প্রতিএকরে অতিরিক্ত খরচসহ মোট খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৩ হাজার টাকা। অথচ প্রতিমণ ধানের দাম ৮শ টাকা ধরে একরে ৫০ মণ ফলন হলেও ৪০ হাজার টাকার বেশি উঠবে না। তাহলে চাষ করে লাভ কী? পেটের দায়ে এবং উপায় নেই বলে কৃষক যদি চাষাবাদ করে তাঁকে কি স্থায়ী উন্নয়নের কৃষি অর্থনীতি বলা যাবে?

বিল গেটস নামটি বললে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার দক্ষতা ও সম্পদের উৎস তিনি মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা, প্রোগ্রামিং দক্ষতার জন্য তিনি সারা পৃথিবীতে পরিচিত মুখ। ২০২১ সালে তিনি সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন অন্য আর এক কারণে। বেসুমার কৃষিজমি কিনেছেন তিনি। তিনি এখন আমেরিকার সবচেয়ে বেশি কৃষিজমির মালিক। নিশ্চয়ই শখের বশে বা খামারে বিলাসিতা করার জন্য জমি কিনছেন না তিনি। কৃষিতে দক্ষতা দেখাতে এবং মুনাফা বাড়াতে চাইছেন এটা স্পষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকার বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বিল গেটস। মার্কিন সাময়িকী ল্যান্ড রিপোর্টের তথ্যমতে, বিল গেটস ২ লাখ ৪২ হাজার একর জমি কিনেছেন। এই জমি কিনতে তিনি খরচ করেছেন প্রায় ১২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমেরিকার ১৮টি অঙ্গরাজ্যে তিনি জমি কিনেছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি কিনেছেন লুইজিয়ানায় (৬৯,০৭১ একর), আরকানসাস (৪৭ হাজার ৯শ ২৭ একর) ও নেব্রাস্কাতে (২০ হাজার ৫শ ৮৮ একর)। দ্য ল্যান্ড রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, বিল গেটসের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ সংস্থা ক্যাসকেড এবং তিনি নিজেই ব্যক্তিগতভাবে এসব জমিতে বিনিয়োগ করছেন। শুধু গেটস নয়, অন্য ধনকুবেররাও জমি কিনেছেন। যেমন, ওয়ান্ডারফুল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা স্টুয়ার্ট এবং লিন্ডা রেসনিকও ( মোট সম্পদ ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন) জমিতে বিনিয়োগ করেছেন। তারা ১ লাখ ৯০ হাজার একর জমি কিনেছেন। লিবার্টি মিডিয়ার প্রধান জন মেলন ২২ লাখ একর জমির মালিক, সিএনএনের প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নারের আমেরিকার আটটি অঙ্গরাজ্য আছে ২০ লাখ একর জমি।

আমাজনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেফ বোজেস লাখ একর জমিতে বিনিয়োগ করে রেখেছেন। হাওয়া বুঝে ব্যবসা করা এবং ব্যবসার হাওয়া ঘুরিয়ে দিতে পারেন যারা, তারা যখন কৃষিজমি কিনছেন এবং বিনিয়োগ করছেন তখন বিশ্বের ভবিষ্যৎ কৃষি সম্পর্কে উদাসীন থাকার কোনো কারণ নেই। ইন্টারনেট ৭ দিন ব্যবহার না করে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে, পত্রিকা না পড়ে বেঁচে থাকা গেলেও খাদ্য ছাড়া যে বাঁচা যায় না, এক সপ্তাহের মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায় তা তারা ভালভাবেই বিবেচনায় নিয়েছেন। তাই ভবিষ্যতের লাভের কথা ভেবে তারা নজর দিয়েছেন কৃষিতে। বাংলাদেশেও কৃষিতে বড় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ হচ্ছে, করপোরেট হাউজগুলো কৃষিজমি কিনছে।

ছোট, মাঝারি কৃষক চড়া দামে কৃষি উপকরণ কেনে আর চোখের জলে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে। ধনী, শিল্পের মালিকদের ঋণ পেতে সমস্যা নেই, ঋণ শোধ না করলেও সমস্যা নেই কিন্তু নিজেরা পিছিয়ে পড়ে দেশকে বাঁচিয়ে রাখছে যে কৃষক তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে গেলে টাকার সংকট। সারে ভর্তুকি না দেয়ার জন্য নাকি চাপ আছে। বড় ব্যবসায়ীরা যেখানে লাভের সম্ভাবনা দেখে কৃষক সেখানে সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কায় আছে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, কোটি কৃষকের পাশে না দাঁড়িয়ে উন্নয়ন স্থায়ী হবে না কোনোভাবেই।

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর