কক্সবাজারের চকোরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের পাঁচ ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটি গত ৯ জানুয়ারি কমবেশি সব পত্রিকায় প্রাধান্য পায়। যে খবর পড়তে গিয়ে পাঠকের চোখে জল আসাই স্বাভাবিক। সবাইকে কমবেশি নাড়া দিয়েছে ভয়াবহ এই দুঃসংবাদটি। বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ৯ ভাইবোনের পাঁচজনই একটি পিকআপ ভ্যানের চাপায় নিহত হন। একইদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও অন্তত ১০জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
কথা হলো সড়ক দুর্ঘটনার মতো সংকট মোকাবিলায় কত রকমের পদক্ষেপ নেয়ার কথা শোনা যায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কেউ কেউ বলেন, দেশে যানবাহনের সংখ্যা বেশি, মানুষ বাড়ছে, তাই দুর্ঘটনাও বাড়ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ জাপানে বাংলাদেশের চেয়ে তো যানবাহন কম নয়। সেখানে কি এত বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে? প্রতিদিন বা বছরে কি এত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে সড়কে? মোটেও না। এমনও দেশ আছে যেখানে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় মাত্র একজন। উন্নত দেশে সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে, আইন কঠোর, সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই দুর্ঘটনাও কম। তবে আমাদের দেশে কেন এত সড়ক দুর্ঘটনা? চলমান এই মৃত্যুর মিছিল কমিয়ে আনার কি কোনো সুযোগ নেই?
এ বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে চকোরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আরও কিছু বলার আছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, যে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় পাঁচ ভাইয়ের প্রাণ গেছে সেই ভ্যানটির নম্বরপ্লেট ছিল না। চালক বা হেলপার ধরা পড়লে হয়ত জানা যাবে গাড়িটির ফিটনেস বা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল কি না। বেপরোয়া চালানোর কারণে যে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকেই স্পষ্ট।
যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, দেশে দায় নেয়ার সংস্কৃতি একেবারেই নেই। কেউ কোনো বিষয়ে দায় নিতে চান না। বরং কায়দা করে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর অপচেষ্টাই বেশি দেখা যায়। সকালে মহাসড়কে এত বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তখন হাইওয়ে পুলিশ কোথায় ছিল? নম্বরপ্লেট ছাড়া গাড়িটি কীভাবে দিনের পর দিন চলেছে? এজন্য কি কারো দায় নেই? যদি চালকের লাইসেন্স বা গাড়ির ফিটনেস না থাকে তাহলে এর দায় কে বা কারা নেবে? এসব দেখার জন্য তো বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলরা ছিলেন। এরকম অসংখ্য গাড়ি সড়কে চলছে দিনের পর দিন। তারা কী করেছেন? স্বজনহারা মানুষগুলোর বেদনা কি প্রশমিত হওয়ার যোগ্য?
এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর সাধারণত দেখা যায় চালক বা হেলপারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করে। একপর্যায়ে তার জামিন হয়। শেষ পর্যন্ত মামলার পরিণতি সম্পর্কে আর জানার সুযোগ থাকে না। যাদের অবহেলায় সড়ক-মহাসড়ক অরক্ষিত, দুর্ঘটনা ঘটছে তাদের কি বিচার হবে না? তাদের কেন আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয় না? কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা কেন আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের হত্যার দায় নিতে চান না? এসব প্রশ্ন আবারও নতুন করে সামনে আনা প্রয়োজন।
সড়ক যাদের দেখভাল করার কথা, যানবাহন বা চালকের কাগজপত্র যাদের নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা, এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা পেলে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবহন মালিকদেরও এসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
শীত মৌসুমে সড়ক ও নৌপথে যানবাহন চলাচলে বাড়তি নির্দেশনা থাকে। সেগুলোর যেমন প্রচার নেই, তেমনি এসব নির্দেশনা মানা হচ্ছে কি না, তা দেখভালেরও যেন কেউ নেই। ফলে আমরা যতই নিরাপদ সড়কের কথা বলি আসলেই কি সড়ক নিরাপদ সম্ভব হবে? প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আর বাৎসরিক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বলছে দিন দিন সড়ক অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বাড়ছে মৃত্যু আর আহতের সংখ্যা। সেইসঙ্গে বাড়ছে অসহায় ও দরিদ্র পরিবার।
চকোরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড বললে অত্যুক্তি হবে না। এটা ফৌজদারি অপরাধ। প্রথমে যারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে হাইওয়ে পুলিশকে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষসহ সর্বোপরি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এ ঘটনার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আমরা দেখতে চাই এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবাই দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ করবেন। দায় স্বীকার করার সংস্কৃতি চালু হলে দায়িত্ব বাড়বে। সড়ক মহাসড়কে বাড়বে নজরদারি। তাহলে দুর্ঘটনাও কমবে।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ১১১ দফা সুপারিশ দেয়। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনারোধে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্মিলিতভাবে কী করছে তা মানুষ জানতে চায়। যদি বাস্তবায়ন হতোই, বা সড়কে নজরদারি বাড়ানো হতো তাহলে দৃশ্যপট বদলে যেত।
যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত মনে করার কোনো কারণ নেই সরকার এ ব্যাপারে খুব তৎপর হয়ে কাজ করছে। সবার আগে দুর্ঘটনারোধে জনসচেতনতা জরুরি। সে কাজটিই করা সম্ভব হয়নি। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কীভাবে সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ হবে? সর্বোপরি সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ এতদিনেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরিবহন মালিক ও শ্রমকিদের চাপে আইনের শাস্তিযোগ্য ২৯টি ধারায় সংশোধনী আনা হচ্ছে আবারও। চার বছরের বেশি সময়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কব্জা থেকে আইনটিকে বাইরে এনে আলোর মুখ দেখাতে পারেনি সরকার। এতসব সংকট চলমান রেখে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। থামবে না মৃত্যুর মিছিলও।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক