ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ে একটা কবিতা পড়েছিলাম, শামসুর রাহমানের লেখা- ‘পণ্ডশ্রম’। চিলে কান নিয়ে গেছে, এই কথা শুনে কানটা ঠিক জায়গায় আছে কি না, সেটা পরখ না করেই চিলের পিছে ছোটার সেই পণ্ডশ্রমের স্মৃতিটা আজকাল নেটিজেনরা বার বার মনে করিয়ে দেন। গত দুদিন ধরেই যেমন দিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে শাখা বদলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এমন একটা ধারণার প্রবল উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এটা সত্যি, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি পদ্ধতির কিছু সংস্কার করতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পঠিত এক শাখা থেকে অন্য শাখার বিভাগে ভর্তি নেয়ার পদ্ধতিটির পরিবর্তন অন্যতম। এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, পরের শিক্ষাবর্ষ থেকে এই পদ্ধতিটি আর থাকবে না। আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তি প্রক্রিয়া শুরুর আগে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। তবে ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে ভর্তি নেয়া হবে না মানে এই নয় যে শিক্ষার্থীদের আর শাখা পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে না। আসলে কিছুটা বাস্তবতার নিরীখেই ভর্তির পদ্ধতিতে খানিকটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিটভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি চালু হয় ১৯৮২ সাল থেকে। তার আগে পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো সরাসরি বিভাগগুলোর তত্ত্বাবধানে।
কিন্তু ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে সেই পদ্ধতি বদলে চালু করা হয় ইউনিট ভিত্তিক পদ্ধতি, যার মূল নীতি ছিল উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রচলিত তিনটি ধারার শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ধারা-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর জন্য একটিমাত্র পরীক্ষা দেবে, সেখান থেকেই মেধাক্রম অনুসারে পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ, বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে সম্মান পর্যায়ে পড়তে চাইলে তাকে বিজ্ঞান শাখার ভর্তি পরীক্ষা (যা সাধারণত ক-ইউনিট হিসেবে পরিচিত) দিতে হবে, মানবিকের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হবে খ-ইউনিটের মাধ্যমে আর ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবে গ-ইউনিটের মাধ্যমে। তবে, এক শাখার শিক্ষার্থীরা অন্য শাখা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়তে চাইলে তাকে আলাদা একটি পরীক্ষা দিতে হবে, সেটি ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত ছিল।
এই ‘ঘ’ ইউনিটে মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের শিক্ষার্থীদের একটি অভিন্ন পরীক্ষা নেয়া হতো বটে, কিন্তু তিন শাখার জন্য তিনটি আলাদা মেধা তালিকা তৈরি করা হতো, সেখান থেকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিক ও বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেতেন। তাত্ত্বিকভাবে মানবিকের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও বাণিজ্য এবং বাণিজ্যের শিক্ষার্থীরা মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগে সুযোগ পাওয়ার কথা, কিন্তু নানা রকম শর্তের বেড়াজালে আটকে যৌক্তিক কারণেই আসলে বাণিজ্য কিংবা মানবিকের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিষয়ে পড়ার সুযোগ খুবই কম।
আসলে এই পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি বিভাগকে বছরের শুরুতেই কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটিকে জানিয়ে দিতে হতো, তারা কোন ইউনিট থেকে কতজন শিক্ষার্থী নেবে। ব্যাপারটা এ রকম: ধরা যাক বাংলা বিভাগে মোট আসন ১০০টি; তারা জানিয়ে দিতো খ-ইউনিটের মাধ্যমে তারা ৬০ জনকে ভর্তি নেবে, ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে বিজ্ঞান শাখা থেকে নেবে ২৫ আর বাণিজ্য শাখা থেকে ১৫, মোট ৪০ জনকে।
এখন বাণিজ্য ও মানবিকের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের অল্প কয়েকটি বিষয়েই পড়া বাস্তবে সম্ভব, সে কারণে এই দুই শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ঘ’ ইউনিট থেকে বাস্তবে আসন বরাদ্দ থাকত খুবই কম। বাণিজ্য অনুষদে বিভাগ মাত্র আটটি, তাই মানবিকের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ঘ’ ইউনিট থেকে আসন বরাদ্দ থাকত আরও কম; সেগুলোতেও আবার থাকত নানা শর্ত। তাই দেখা যেত, ‘ঘ’ ইউনিটে মানবিক শাখার মেধা তালিকার প্রথম পঞ্চাশজনের মধ্যে থেকেও অনেক ক্ষেত্রে ভর্তির সুযোগ মিলত না। কিন্তু এই অল্পসংখ্যক আসনের জন্য ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, কারণ উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ সকল শাখার শিক্ষার্থীরাই এই ইউনিটের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পেতেন। যেমন গত শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার ভর্তিচ্ছু।
এই বিপুল সংখ্যক ভর্তিচ্ছুর পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা মোটেই সহজ কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এত দিন এই কাজটি করে আসছিল ঠিকই, কিন্তু এর একটি যৌক্তিক ও কার্যকর বিকল্প খোঁজা জরুরি হয়ে উঠেছিল।
গত কয়েক বছরে এর একটি বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। সেই পদ্ধতিতে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নিজ শাখার ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকা থেকেই পছন্দ অনুসারে অন্য শাখা-সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহে ভর্তির সুযোগ থাকছে। এই পদ্ধতিতে আগের মতোই বিভাগগুলো স্থির করবে তাদের অনুমোদিত আসনের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকের কোন শাখা থেকে উত্তীর্ণ কতোজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হবে। তবে এই আসনগুলি পূর্ণ করা হবে সংশ্লিষ্ট শাখার মেধা তালিকা থেকে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন থাকবে, কিন্তু সেই আসনগুলি ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকা থেকেই পূরণ করা হবে।
চলমান পদ্ধতির সঙ্গে আসলে এর খুব একটা পার্থক্য নেই। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর ‘ক’ ইউনিটে আসন সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮১৫টি আর ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে বিজ্ঞান শাখা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে ছিল আরও ৭৫০টি আসন। নতুন পদ্ধতিতে ওই ৭৫০টি আসনও থাকবে ‘ক’ ইউনিটের অধীনে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সে জন্য আলাদা আরেকটি পরীক্ষা দিতে হবে না, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন তাদের মেধা ও পছন্দক্রম অনুসারে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়, সেভাবেই এই আসনগুলোও পূরণ করা হবে।
উদাহরণ হিসেবে ‘ক’ ইউনিটের মেধা তালিকার মাঝামাঝি স্থানে থাকা একজন শিক্ষার্থীর কথা ধরা যাক। তিনি হয়তো পড়তে চেয়েছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স, কিন্তু পরীক্ষায় তার চেয়ে ভালো করা শিক্ষার্থীরা আগেই সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় ওই বিভাগের আসন পুর্ণ হয়ে গেছে। এখন তিনি হয়তো বিজ্ঞান অনুষদ থেকে পেতে পারেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান কিংবা ধরুন মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ। কিন্তু এগুলোর চেয়ে তিনি পছন্দ করলেন অর্থনীতি বিভাগকে, তাহলে তিনি অর্থনীতি বিভাগেই পড়ার সুযোগ পাবেন, যদি ওই বিভাগে বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ আসন তখনও খালি থাকে।
একইভাবে ‘খ’ ইউনিটের মাধ্যমে মানবিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী যেভাবে মেধা ও পছন্দের ভিত্তিতে আইন কিংবা অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান, সেভাবেই মানবিক শাখার জন্য বরাদ্দ ম্যানেজমেন্ট, অ্যাকাউন্টিং বা মার্কেটিং বিভাগের আসনগুলোতে ভর্তি হওয়ারও সুযোগ পাবেন।
এই পদ্ধতিটি কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতির মতো কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া একেবারে হুট করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে গত তিন শিক্ষাবর্ষ ধরে এই পদ্ধতিটি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এমন নয় যে হুবহু ওই পদ্ধতিটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে এই মডেলটির কথা বলা এই কারণে যে আসলে ওই মডেলটি সামনে রেখে শাখা পরিবর্তনের সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব। তাই ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্তটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভাগ পরিবর্তনের দুয়ার বন্ধ করছে, এই কথাটি মোটেই ঠিক নয়; এতে বরং তাদের অহেতুক কিছু কষ্ট কমবে।
এ ছাড়া আরও একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছে, ঘ-ইউনিটের পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে নাকি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বাস্তবে তেমন কিছু হওয়ার কোনো কারণ নেই, কেননা ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ পরিচালনা করতো বটে, কিন্তু এটা কখনই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা ছিল না। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সামাজিক বিজ্ঞান শাখা নেই, তাই এই অনুষদের বিভাগগুলোর সিংহভাগ আসনে ভর্তি নেয়া হয় মানবিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে, ‘খ’ ইউনিটের মাধ্যমে। কলা ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের মতোই এই অনুষদের বিভাগগুলোরও সীমিতসংখ্যক আসন পূরণ করা হতো ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে, বাস্তবে ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞানের চাইতে কলা অনুষদেই বরং বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতো। তাই ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা নেয়া না হলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়ায় আসলে খুব বেশি পরিবর্তন হবে না।
সামাজিক বিজ্ঞানের বিভাগগুলোতে ছাত্র ভর্তির জন্য আলাদা একটি ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের যুক্তিটা কিন্তু উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। তবে, সেটা পুরনো ‘ঘ’ ইউনিটের আদলে নয় কোনোক্রমেই- সে জন্য নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।
সেটা আসলে সকল ইউনিটের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। চলমান পদ্ধতিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহীদের মধ্য থেকে সেরাদের আসলেই বাছাই করে নিতে পারছি কি না, সেটা এটা আলাদা বিতর্ক। এ বিষয়েই নজর দেয়া সবচেয়ে জরুরি, আমরা যেটা ভুলে থাকছি।
এ কে এম খাদেমুল হক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়