বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সরব ও নীরব ঘাতকে জেরবার জীবন

  • শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া   
  • ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৯:২৪

শব্দদূষণ সরবে জানান দিচ্ছে, সে ক্ষতিকর। বায়ুদূষণ নীরবে ক্ষতি করছে মানবজীবন ও অন্য প্রাণীর। কেবল সচেতনতার অভাবেই এসব ক্ষতিকর বিষয়ে থেকে যাচ্ছে অলক্ষে, আড়ালে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাড়াশব্দ চোখে পড়ে না।

রোজকার জীবনে শব্দের বিশেষ তাৎপর্য আছে বটে। শব্দহীন জীবন যেমন অসীম মহাশূন্যে বেতাল বিচরণের মতো, তেমনি এই শব্দই বিষিয়ে তুলতে পারে কারো কারো জীবন।সেদিন পত্রিকায় পড়লাম ইতালির লা স্পেজিয়া শহরের এক ঘটনা। পাশের ফ্ল্যাটের টয়লেটে ফ্লাশের শব্দ সইতে না পেরে আদালতে মামলা ঠুকে দেন এক দম্পতি। চার ভাই মিলে থাকত ওই ফ্ল্যাটে। শুরুতে অসহনীয় ওই শব্দের ব্যাপারে ভাইদের কাছে অভিযোগ দেন দম্পতি। কিন্তু তারা আমল দেয়নি। তাই আদালতে যাওয়া। টানা ১৯ বছর চলেছে ওই মামলা। শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টে ফয়সালা। ক্ষতিপূরণ বাবদ আট হাজার ইউরো পেয়েছেন ওই দম্পতি।এ ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে ইতালির মতো ইউরোপীয় দেশে শব্দের একটা পরিমিতি আছে, আছে শব্দ নিয়ন্ত্রণের শিষ্টাচার, যে রীতিতে তারা অভ্যস্ত। সেখানে কানে লাগার মতো সামান্য শব্দেও বিচার চেয়ে সমাধান পাওয়া সম্ভব। আর আমাদের এখানে?উত্তর কী দেব, আমরা বেশির ভাগই গা-সওয়া মানুষ। আমাদের জীবনস্রোতে হইচই-হাঁকডাক কিছুই না। বরং কষ্টেকাতর ক্লেদকান্ত মানুষ নেচেকুঁদে জোরালো হাঁক দিতে পারলে যেন হালকা বোধ করে। জীবনযুদ্ধের ডামাডোল অনেকের কাছে স্রেফ ডালভাত। ঘরের ভেতর রাতদিন বাগযুদ্ধ যেন ঝঞ্ঝামুখর জীবনের অলংকার। গাড়ির ভেঁপু, ট্রেনের হুইসেল একদিন না শুনলে অনেকে ভাবেন, জীবনযুদ্ধে না জানি কী ছন্দপতন ঘটে গেল!এরপরও কিছু ব্যতিক্রম আছে বৈকি। নির্মাণকাজের পাইলিং, ভারী যন্ত্রের ড্রিলিং, টাইলস ও রড কাটিং, মেশিনে খোয়া ভাঙা- এসব শব্দে তিষ্টানো দায়। কিংবা কোনো গাড়ির আচানক ঘন ঘন হর্ন? সে আর কহতব্য নয়। বাড়ির পাশে রাইস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার মিল বা মশলা পেষার মিল থাকলে সে বাড়ির মানুষের আরাম হারাম। ঘনবসতির কোনো জায়গায় যদি রাতভর মাইক বাজিয়ে কোনো অনুষ্ঠান চলে, সেখানেও একই সমস্যা।খ্রিস্টীয় নবর্বষ বরণের উৎসবের রাতে হাজারও বাজি-পটকার বিকট আওয়াজ শব্দ-সন্ত্রাস হয়ে কীভাবে নগরবাসী অনেকের জন্য ত্রাস হয়ছিল, এর সাক্ষী সারা ঢাকাবাসী। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ধারে একটা বাড়িতে ছিলাম অনেক দিন। সড়ক থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে একটা ঘরে থাকতাম।

সড়ক ছিল ট্রাক-বাস, রিকশা-স্কুটারে ভরপুর। রাতদিন নানা রকমের ইঞ্জিনের শব্দ, নানা ধরনের ভেঁপুর প্যাঁ-পোঁ আর মানুষের হল্লায় কান-ঝালাপালা। আমাদের কাছে অবশ্য তেমন মালুম হতো না। সয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলে মুরব্বিরা অবাক হয়ে বলতেন, ‘এখানে থাকিস কী করে?’শীত বা গরমের ছুটিতে গ্রামে গিয়ে রাতে শান্তির ঘুম দিতাম। কখনও গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম চারপাশ কী সুনসান! মনে হতো মাটির ধরা নয়, অন্য কোথাও আছি।আর শহরে? গভীর রাতে সড়ক দিয়ে ওভারলোডেড ট্রাক-লরি গেলে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠেছে বাড়ি। সেটাও অবশ্য অভ্যস্ততায় আমাদের সয়ে গেছে। একবার এক খালু বেড়াতে এসেছেন। গভীর রাতে বাড়ি কেঁপে উঠতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। কাঁপ ধরা গলা চেঁচালেন, ‘ওঠো সবাই। ভূমিকম্প হচ্ছে!’প্রায়ই গভীর রাতে ওই সড়কের ধারেকাছে ট্রাক বা বাসের ইঞ্জিন মেরামতের কাজ হতো। কিংবা চাকা পাল্টানো হতো। তখন হেভিওয়েট হাতুড়ি যে শব্দ তুলত, ঝেড়ে পালাত ঘুম। পরদিন দিনমান টনটন করত মাথা। এখন ভাবি, এতগুলো বছর সেখান কীভাবে বাস করেছি!খুঁজে দেখলে অনেক দৃষ্টান্ত মিলবে, যেখানে শব্দের প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারো না কারো ক্ষতি করে যাচ্ছে। দেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, কোন এলাকায় দিনের কোন সময়ে কী ধরনের শব্দদূষণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিধি অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবল ও দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল ছাড়াতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৬০ ও ৭০ ডেসিবেলে রাখতে হবে।

ডেসিবেল হলো শব্দের একক। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদলতের আশেপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব স্থানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।এখন যানবাহন বা শব্দ উৎপাদনের উৎস থেকে এই বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, তা দেখছে কে?দেশে বিভিন্ন স্থানে ভেজালবিরোধী অভিযান চলে, যানবাহনের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরখে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রতিষ্ঠায় হোটেল-রেস্তোরাঁ আর কাঁচাবাজারেও চলছে অভিযান, কিন্তু শব্দদূষণ রোধে কি কোনো কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে মাঠে দেখা যায়? অথচ এই সরব ঘাতব চোখের সামনেই সাড়ে সর্বনাশ করে দিচ্ছে সবার। এ ব্যাপারে সরকার থেকে পদক্ষেপ জরুরি।সরব ঘাতকের পর আসি নীরব ঘাতক প্রসঙ্গে। তা হলো বায়ুদূষণ। সে আরও মারাত্মক। গত ডিসেম্বরে বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সে অনুযায়ী বিশ্বের ১০০টি প্রধান শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা ছিল শীর্ষে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক রোববার দিন ও রাতের বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের রাজধানীর বায়ু ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, তৃতীয় স্থানে ভারতের কলকাতা ও চতুর্থ ভারতেরই আরেক শহর দিল্লি। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও একদিনের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণে ঢাকা শীর্ষস্থানে পৌঁছে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে দিন দিন ঢাকায় নির্মল বাতাস পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত একদিনও বিশুদ্ধ বাতাস পায়নি ঢাকাবাসী।

ঢাকার বাতাস এতটাই দূষণের শিকার যে, গত ছয় বছরে মাত্র ৩৮ দিন বিশুদ্ধ বাতাস মিলেছে। সে হিসাবে ইট-পাথরের এই নগরের মানুষ বছরে গড়ে ছয়দিন বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেয়ার সুযোগ পেয়েছে।

বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। ঢাকার বাতাসই কেবল নয়, জলও দূষিত। রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ- এসব নদ-নদীর কালো জলের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। নদীতে একটা জলজ গন্ধ থাকে। ঢাকার নদীগুলোর, বিশেষ করে বুড়িগঙ্গার জলোহাওয়ায় শ্বাস টানা যায় না। সেখানে সেফটি ট্যাংকির কালো বর্জ্যের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়।

পানি আর বাতাস দূষিত হওয়ার মূলে কিন্তু আমরাই। নদ-নদী দূষিত হচ্ছে কল-কারখানার বর্জ্যে আর বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনায়। এর মধ্যে বেশি ক্ষতি করছে প্লাস্টিক জাতীয় অপচনশীল বর্জ্য। নগরের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, কল-কারখানার ধোঁয়া, রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন, ব্যাপক হারে পোশাক কারখানার উৎপাদনে। বাসাবাড়ির আবর্জনা নিষ্কাশনেও সুব্যবস্থা নেই। যে যার মতো ফেলছে। যারা নিয়মিত ময়লা টানে, তারা বেশির ভাগই নিয়ম মেনে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ময়লা ফেলে না। যেখানে সেখানে আবর্জনা পোড়ানো হচ্ছে। এতে দূষিত হচ্ছে বাতাস।

ঢাকার উপকণ্ঠে রয়েছে বেশ কিছু ইটভাটা। সেগুলোর চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ার ব্যাপক কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকায় এটি বায়ুদূষণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গত বছরের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, আমাদের দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটা আছে। ১০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করছেন এসব ইটভাটায়। এই ১০ লাখ পরিবারের অন্য সদস্য সংখ্যা মিলিয়ে আরও বেশ কিছু মানুষদের প্রতিদিনের সকালটা শুরু হয় জ্বলন্ত চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া দেখতে দেখতে। এমনকি এর নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়ে।

ঢাকার বিভিন্ন সড়কে বলতে গেলে সারা বছরই উন্নয়ন বা সংস্কারমূলক বিভিন্ন খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলে। সেখানে থেকেও ধুলো ও ধোঁয়ার উৎপত্তি হয়। তা থেকেও বায়ুদূষণ ঘটছে। রাজধানীতে পেট্রোল-ডিজেলে যেসব যানবাহন চলে, সেগুলোর বড় একটা অংশের ফিটনেস থাকে না। এগুলো কালো ধোঁয়া নির্গত করে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে।

বায়ুদূষণের বিষয়টি এমন, কেবল আইন করে বা অভিযান চালিয়ে তা রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠা বা সেভাবে স্বাস্থবিধি মেনে চলাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজে সচেতন না হলে তো আমার শরীর-স্বাস্থ্য অন্য কেউ রক্ষা করে দেবে না।

শব্দদূষণ সরবে জানান দিচ্ছে, সে ক্ষতিকর। বায়ুদূষণ নীরবে ক্ষতি করছে মানবজীবন ও অন্য প্রাণীর। কেবল সচেতনতার অভাবেই এসব ক্ষতিকর বিষয় থেকে যাচ্ছে অলক্ষে, আড়ালে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাড়াশব্দ চোখে পড়ে না। অথচ তাদের ভূমিকা ব্যাপক। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে তারাই পারে আসল ভূমিকা রাখতে। আইনের প্রয়োগও তাদের দ্বারা জোরালোভাবে সম্ভব। এ ব্যাপারে আন্তরিক ও জোরালো ভূমিকা আবশ্যক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর