সন্ধ্যায় হঠাৎ নিউজরুমে সাড়া পড়ে গেল- কাজী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন। রুটিন যা যা কাজ তাই করলাম। খবরটি কনফার্ম করে ব্রেকিং দেয়া হলো। কোন হাসপাতালে মারা গেছেন, সেটা নিশ্চিত করে একজন রিপোর্টার পাঠালাম সেখানে, আরেকজন বসে গেলেন তার জীবনী বানাতে। সবই হলো যন্ত্রের মতো। কিন্তু বুঝিনি, একজন অদেখা মানুষের মৃত্যু এতটা আচ্ছন্ন করে ফেলবে। আসলে শুধু আমাকে নয়, কাজী আনোয়ার হোসেন যুগ যুগ ধরে আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। এখন ফেসবুক প্রজন্ম হয়তো বুঝতেও পারবে না, কাজী আনোয়ার হোসেন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন আমাদের কাছে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের অনেক পরিচয়। সেটি নিয়ে বিস্তারিত লেখা যাবে। তবে এটিএন নিউজের ব্রেকিং নিউজে লেখা হলো- ‘মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই।’ সব পরিচয় ছাপিয়ে মাসুদ রানার স্রষ্টাই তার মূল পরিচয়। মাসুদ রানার লেখক কে, এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। শেখ আব্দুল হাকিম মাসুদ রানা সিরিজের অনেকগুলো বইয়ের লেখক হিসেবে আদালতের স্বীকৃতি পেয়েছেন। শুধু শেখ আব্দুল হাকিম নন, আমরা জানি আরও অনেকেই মাসুদ রানা লিখেছেন।
১৯৬৬ সালে প্রকাশিত মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম দুটি বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ আর ‘ভারতনাট্যম’ এবং পরে প্রকাশিত ‘পিশাচ দ্বীপ’ ছাড়া এই সিরিজের প্রায় ৪৫০ বইয়ের বাকি সবই বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে লেখা। কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেও কখনও একে মৌলিক লেখা বলে দাবি করেননি। কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে প্রকাশিত হলেও এর অনেক বই-ই তার লেখা নয়, তবুও কাজী আনোয়ার হোসেনই মাসুদ রানার স্রষ্টা।
কাজী আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর খবরে বছর পাঁচেক আগের একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। ২০১৬ সালে মাসুদ রানার ৫০ বছরপূর্তি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছিল। অফিসে বসে আমি আর মুন্নী (মুন্নী সাহা) মাসুদ রানা নিয়ে কথা বলছিলাম। স্মৃতির পুকুরে তোলপাড়। হঠাৎ মুন্নী বলল, চল মাসুদ রানার সঙ্গে দেখা করে আসি। মাসুদ রানার নাম শুনেই রক্তে শিহরণ লাগল, ভর করল রাজ্যের নস্টালজিয়া। আসলে মাসুদ রানা নয়, মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের খোঁজে বের হতে চায় মুন্নী। আমি বললাম, আমি যতদূর জানি কাজী আনোয়ার হোসেন খুব প্রচারবিমুখ ও ঘরকুনো মানুষ। সাধারণত তিনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না, বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে তো নয়ই। মাসুদ রানার মতোই তার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনও নিজেকে রহস্যময়তার চাদরে আড়াল করে রাখেন। ইনফ্যাক্ট আমরা তো তার বাসাও চিনি না।
আমি বললাম, দাঁড়া, আমি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার চেষ্টা করি। ফোন করলাম, কাজী আনোয়ার হোসেনের চাচাতো ভাই সারগাম সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেনকে। তিনিও বললেন, বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে গিয়ে কোনো লাভ নেই। তিনি আশ্বাস দিলেন, আমাদের জন্য শিগগিরই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু মুন্নী নাছোড়বান্দা, সে যাবেই। তাই বাধ্য হয়ে গুগল সার্চ দিয়ে সেবা প্রকাশনীর ঠিকানা বের করলাম, ২৪/৪ সেগুনবাগিচা। এটুকু ভরসা করে রওয়ানা দিলাম।
একদম শুরুর দিকে ঢাকায় আমার আস্তানা ছিল ৭৬ সেগুনবাগিচা, সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের অফিস। তখন ছায়া ঢাকা, পাখি ঢাকা না হলেও নিরিবিলি সেগুনবাগিচার পুরোটাই চিনতাম। বাইরে থেকে সেবা প্রকাশনীর অফিসও দেখেছি। কিন্তু গত ২৫ বছরে সেগুনবাগিচা এতটাই বদলে গেছে, এখন গেলে সবকিছুই অচেনা মনে হয়। বাগানবাড়ির মতো বিশাল সব বাড়ির জায়গা নিয়েছে উঁচু ভবনগুলো। ২৪/৪ সম্বল করে সেগুনবাগিচায় চক্কর দিতে থাকলাম। ২৪ পাই, কিন্তু ২৪/৪ পাই না। শেষ পর্যন্ত মুন্নীকে গাড়িতে বসিয়ে নেমে জিজ্ঞাসা করে করে বের করলাম ২৪/৪ সেগুনবাগিচা। দেখলাম একটা চোখে না পড়ার মতো ছোট সাইনবোর্ডও আছে, ‘কাজী আনোয়ার হোসেন, ২৪/৪ সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০’। কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি আর নেই।
তার জায়গা নিয়েছে সুউচ্চ ভবন। গেটের কাছে গিয়ে মুন্নীকে বললাম, এবার আমার কাজ শেষ, তোর মাস্তানি শুরু। দেখ চেহারা বেচে কিছু করতে পারিস কি না। কাজ হলো। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন মুন্নীকে চিনল। খাতিরও করল। কিন্তু ‘স্যার’-এর অনুমতি ছাড়া তো আর ওপরে যাওয়া যাবে না। আমাদের সামনেই ফোন করলেন। ও প্রান্তের কিছু কথা আমরা আবছা আবছা শুনলামও। টেলিফোনের ওপাশে কাজী আনোয়ার হোসেন, সেবা প্রকাশনীর আরও অনেক নিয়মিত পাঠকের মতো আমার কাছে তিনি কাজীদা, এক ধরনের থ্রিল অনুভব করলাম। কিন্তু এত কাছে তবু কত দূর। অনুমতি মিলল না। বললেন, অসুস্থ। বুঝলাম, অজুহাত। আমাদের পীড়াপীড়িতে নিরাপত্তাকর্মীরা আবার ফোন করলেন।
বললেন, আমরা কোনো সাক্ষাৎকার নিতে আসিনি, সঙ্গে ক্যামেরাও নেই। জাস্ট দেখা করতে এসেছি। বাসায়ও ঢুকব না। বাইরে থেকে দেখা করে চলে যাব। কিন্তু লাভ হলো না। অনুমতি মিলল না। নিরাপত্তাকর্মীরা কথায় কথায় বললেন, আগের বছর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের মৃত্যু এবং মেয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার পর উনি অনেকটাই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন। কারো সঙ্গেই দেখা করেন না। অবশ্য দেখা উনি আগেও করতেন না। ওনার নেমপ্লেট পেছনে রেখে একটা সেলফি তুলে দুই বন্ধু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। দুধের স্বাদ ঘোলা পানিতে মেটানোর অপচেষ্টা।
মাসুদ রানাকে নিয়ে প্রায় পঞ্চাশের দুই বন্ধুর এই আদিখ্যেতা দেখে এই প্রজন্মের কেউ কেউ অবাক হতে পারেন। কিন্তু তারা বুঝতেই পারবে না, আমাদের প্রজন্মের কাছে মাসুদ রানা কতটা! শুনলাম মাসুদ রানা এখনও প্রকাশিত হয়। তবে আমি অন্তত ৩০ বছর ধরে মাসুদ রানা পড়ি না। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত প্রায় সব মাসুদ রানাই পড়া ছিল। মাসুদ রানা ছিল নেশার মতো, তীব্র নেশা। পড়ার টেবিলে বইয়ের নিচে লুকিয়ে, এমনকি ক্লাসরুমে লুকিয়েও মাসুদ রানা পড়েছি। একবার হাতে নিলে শেষ না করে ওঠা যেত না। সামনে যত কাজই থাকুক। এমনকি পরীক্ষার আগের রাতে লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়ার মতো ‘অপরাধ’ও করেছি। আসলে আমরা বেড়েই উঠেছি মাসুদ রানার সঙ্গে, মাসুদ রানার সময়ে। মাসুদ রানা আমাদের সমান বয়সী।
মাসুদ রানার বয়স যখন ৫০, আমার তখন ৪৭। তবে মাসুদ রানার বয়স বাড়ে না, আমরাই খালি বুড়িয়ে যাই। আমি ভাগ্যবান যে আমার ছেলেবেলা মোবাইল, ফেসবুকে অপচয় হয়নি। আনন্দময় শৈশবের রহমস্যময়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল মাসুদ রানা। প্রতিটি বইয়ের ভূমিকাতেই মাসুদ রানার পরিচিতি লেখা থাকত ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টালিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ দেশান্তরে।... কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।’ কিন্তু আমরা জড়িয়ে যাই অচ্ছেদ্য এক বাঁধনে। আমাদের ছেলেবেলা কুয়াশা, ব্যোমকেশ, ফেলুদা, দস্যু বনহুরময়। তবে সত্যি বলতে কি মাসুদ রানার মতো আর কেউ এমন বাঁধনে জড়ায়নি।
সাহিত্যমূল্যে হয়তো মাসুদ রানা অনুল্লেখযোগ্যই থেকে যাবে। সাহিত্য ইতিহাসে মাসুদ রানা হয়তো পরিশিষ্ট। কিন্তু বোদ্ধারাই মূল্য বা ইতিহাস নিয়ে থাকুক। আমার তাতে আগ্রহ নেই। আমি জানি মাসুদ রানা আমার, আমাদের জন্য কতটা। কেউ কেউ আমার গদ্যের প্রশংসা করেন। করলে আমি সেই প্রশংসার পুরোটাই কাজী আনোয়ার হোসেনকে উৎসর্গ করি। ’৯৩ সালে আমি যখন বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করি, তখন স্পোর্টসে কাজ করতেন শামসুল ইসলাম কবির।
এখন তিনি কানাডাপ্রবাসী। তো কবির এসে একদিন আমার কাছে দুঃখ করে বললেন, ভাই, বড় বিপদে আছি। আযম ভাই (শহীদুল আযম) তো সারাক্ষণ বকাবকি করেন। আমার লেখা ভালো না। কী করি বলেন তো। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, আপনি মাসুদ রানা আর হুমায়ুন আহমেদ পড়েন। পড়তে ভালো লাগবে এবং আমি নিশ্চিত আপনার লেখারও অনেক উন্নতি হবে। শামসুল ইসলাম কবির ফল পেয়েছিলেন হাতে হাতে। কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তিনি।
ঢাকায় আমার প্রথম কর্মক্ষেত্র সাপ্তাহিক বিচিন্তা, প্রথম বস মিনার মাহমুদ। তিনি মাসুদ রানায় প্রভাবিত ছিলেন দারুণভাবে। নিজেকে তিনি দাবি করতেন রাহাত খান। আর আমাদের সবাইকে বলতেন মাসুদ রানা। তিনি আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট দিতেন মাসুদ রানা স্টাইলে। মিনার মাহমুদ অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করতেন।
শুধু মিনার মাহমুদ নন; আমরা, আমাদের প্রজন্ম মাসুদ রানায় কতটা প্রভাবিত; কাগজে-কলমে কখনই তার পুরোটা ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না। হয়তো আমরা পুরোটা জানিও না; চেতনে-অবচেতনে মাসুদ রানা আমাদের কতটা জুড়ে আছে। লেখার কথা তো আগেই বলেছি। ছোট ছোট বাক্যে মাসুদ রানার ঝরঝরে গদ্য টেনে নেয় যে কাউকে। মাসুদ রানা পড়তে পড়তে একটা সহজবোধ্য স্মার্ট গদ্য পাঠকের মননে ছাপ ফেলে যায়। কাহিনির মতো গদ্যের ছিল যেন টানটান উত্তেজনা।
মাসুদ রানাকে আমি বলি- আই ওপেনার। আমাদের জন্য পড়ার আনন্দের সিংহ দরজাটা খুলে দিয়েছিল মাসুদ রানা। মাসুদ রানা পড়তে পড়তেই ছেলেবেলায় ‘আউট বই’ পড়ার নেশাটা চেপেছিল, সেটা আর কাটেনি। আকাঙ্ক্ষা করি কখনও না কাটুক। বয়স হলে নিশ্চয়ই অনেক অসুখ-বিসুখ হবে, হচ্ছেও। কামনা করি যেন কখনও চোখের অসুখ না হয়। কারণ পড়ার আনন্দটাকে আমি বেঁচে থাকার আনন্দের সমার্থক ভাবি।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে, একদম অজপাড়াগায়। হারিকেন বা কুপির আলোয় লুকিয়ে লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়তে পড়তে আমরা ঘুড়ে বেড়াতাম বিশ্বজুড়ে। আহা, কী যে আনন্দময়, রোমাঞ্চকর শৈশব! এমনিতে আমি খুব আনস্মার্ট। এখনও আমার প্রিয় পোশাক লুঙ্গি। আমার স্ত্রী মুক্তি আর ছেলে প্রসূন আমাকে প্রায়শই ‘গেরাইম্যা’ বলে ঠাট্টা করে। আমি অবশ্য একে গালি হিসেবে নয়, প্রশংসা হিসেবেই নেই। তবুও অজপাড়াগা থেকে উঠে এসে যে শহরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছি, তার অনেকটা অবদানই মাসুদ রানার। তার হার না মানা মানসিকতা, শেষ পর্যন্ত লেগে থাকার চিন্তা আমাদের লড়াইয়ে রসদ জুগিয়েছে।
মাসুদ রানার আরেকটা বড় অবদান, পাঠকের মনে অনায়াসে দেশপ্রেমের বীজ বুনে দেয়া। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টালিজেন্সের স্পাই মাসুদ রানা বিশ্বসেরা। এখন অনেক কিছুতেই বাংলাদেশ সেরাদের কাতারে। কিন্তু ৪০/৪৫ বছর আগে বাংলাদেশ এমন ছিল না। দারিদ্র্য, সাইক্লোন, বৈদেশিক সাহায্য- এসবই ছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। হীনন্মন্যতার সেই সময়ে মাসুদ রানা আমাদের বুকের ছাতি ফুলিয়ে দিত।
শুধু মাসুদ রানা নয়, কাজী আনোয়ার হোসেন তার সেবা প্রকাশনী দিয়ে আমাদের আরও অনেক উপকার করেছেন। প্রথমত পেপারব্যাক হওয়ায় সস্তায় বই পাওয়া যেত। বাংলাদেশের বাকি প্রকাশনা শিল্পের পুরোটাই ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। কিন্তু সেবা প্রকাশনীর বই প্রকাশিত হয় বছরজুড়ে।
সেবা প্রকাশনীর বই পাওয়া যেত রেলস্টেশনে, বাসস্টেশনে, এমনকি পাড়ার চায়ের দোকানেও। কিশোর পত্রিকা বা তিন গোয়েন্দা শিশু-কিশোরদের পাঠে আগ্রহী করেছে। এছাড়া ক্ল্যাসিক আর ওয়েস্টার্ন পড়েও অনেক সময় কাজে লাগিয়েছি। আহা আমার খুব আফসোস, এখন যদি ইন্টারনেট, ফেসবুক না থাকত; যদি আমাদের সন্তানেরা আমাদের মতোই বই পড়ার পেছনে অনেক সময় দিত! তারা যদি জানত, কত আনন্দময় সে জগৎ।
আমাদের সবার জীবন আনন্দময় করে কাজী আনোয়ার হোসেন যাপন করছেন নিঃসঙ্গ জীবন। তবুও তিনি ছিলেন, এটা একটা ভরসা ছিল। তার বিদায়ে অবসান ঘটল একটি যুগের।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক।