জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ৫ জানুয়ারি। বিএনপি এটিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে আয়োজন করে। তাতে বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেছেন। এতে মহানগর উত্তর এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতা বক্তৃতা করেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মূল বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, আগামীতে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হলে বিচারপতি খায়রুল হকের বিচার করা হবে। তিনি আরও বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করায় ২০১৪ সালের নির্বাচন আমরা বর্জন করেছিলাম। এর নায়ক ছিলেন কে?
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক (এবিএম খায়রুল হক)। যদি ভবিষ্যতে কোনোদিন সত্যিকার অর্থে জনগণের সরকার, গণতন্ত্রের সরকার আসে তাহলে বিচারপতি খায়রুল হকেরও বিচার হবে গণতন্ত্র, বাংলাদেশের সংবিধানকে ধবংস করার জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য।” মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে এককভাবে দায়ী করে তার বিচারের যে হুমকি দেয়া হয়েছে, তা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিই শুধু নয়, বিশেষ একজন বিচারককে দায়ী করে বিচার করার যে ‘হুমকি ও প্রতিশ্রুতি’ দেয়া আইন, গণতন্ত্র ও বিচারে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন করতে পারে কি না সেটি অবশ্যই বিচার্য বিষয়।
২০১১ সালের ১০ মে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় প্রদান করেন। সুপ্রিম কোর্ট নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৌলিক বেশ কিছু দুর্বলতা দেখিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ৩ মাসের সরকার নির্ধারিত ৯০ দিন সময় অতিক্রম করার নজির স্থাপনের সম্ভাবনাটিও ২০০৫-০৮ সালে পরিচালিত সরকারে ঘটার উদাহরণ তুলে ধরেন। আদালত সাবেক প্রধান বিচারপতির প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের বিধানের ফলে বিচার বিভাগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টিও উল্লেখ করেন।
তাছাড়া দেশ অনির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ সংবিধানে রাখার বিপদ, ঝুঁকি এবং সাংঘর্ষিকতা সম্পর্কেও আদালত তুলে ধরেন। জটিল এই বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপনের মাধ্যমে আইন আকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গ্রহণ করারও নির্দেশনা দেয়া হয়। সেই ভিত্তিতেই এই রায় অনুযায়ী দেশে সরকারব্যবস্থা নিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত) সঙ্গে সংবিধানে সৃষ্ট সাংঘর্ষিকতা দূরীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ২০১১ সালের ৩০ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ও নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিল সংসদে উত্থাপিত হয় এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নামে তা গৃহীত হয়। বিএনপি তখন এই বিলের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে দেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপ নির্বাচনসহ অনেক নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়।
এসব নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত বেশিরভাগ প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এর বিরোধিতা করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নের একটি আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাতে অংশগ্রহণেও অস্বীকৃতি জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার একটি রূপরেখা সংসদে বিরোধী দলসমূহের জন্য উপস্থাপন করেছিলেন। তাতে প্রধানমন্ত্রীর অধীন সরকারি দলের ৫ এবং বিরোধী দলের ৫ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার বাংলাদেশে কার্যকর থাকবে, যা নির্বাচনকালে কোনো নীতিনির্ধারণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। সেই সরকারের বিরোধী দল থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে থাকার প্রস্তাবও করা হয়।
সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সেই সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের সদস্যরা যদি আলোচনার ভিত্তিতে একটি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার কাঠামো ও কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সংসদে তা আইন আকারে গ্রহণ করত তাহলে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আস্থা অনাস্থার যে সংকট রয়েছে, তা নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিএনপি তখন সেই উদ্যোগটি পণ্ড করে দিয়ে নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়।
২০১৩ সালে অক্টোবর পরবর্তী সময়ে বিএনপি এবং জামায়াত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী যে তাণ্ডব, গণপরিবহণ ও সড়কপথে অগ্নিসংযোগ, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, অবরোধ, থানায় অগ্নিসংযোগ, পুলিশ হত্যা, নির্বাচন কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ এবং নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের আক্রমণ ও হত্যা করেছিল সেটি নজিরবিহীন।
বিএনপি এবং জামায়াতের এই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকে যেকোনো মূল্যে অনুষ্ঠিত না করতে দিয়ে দেশে একটি সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ক্ষমতা দখল করে নেয়া। এ ধরনের পরিকল্পনা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক শক্তি করতে পারে না। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং জামায়াত দেশে তখন সংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতার পরিবর্তনের চাইতে অসংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল।
এর আগেও ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার আড়ালে সারা দেশ থেকে রাতের বেলায় জামায়াত শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করার মাধ্যমে তাহরির স্কয়ারের আদলে রাস্তায় অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে সরকার পতনের ব্যবস্থা করা।
এরপর ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সামনে রেখে জামায়াত এবং বিএনপি ঢাকায় ৬ মে তারিখে সচিবালয়, বায়তুল মোকাররমসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে সরকার পতনের পরিকল্পনা করেছিল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেয়ার মাধ্যমে ৬ জানুয়ারি দেশে সংবিধান ও সরকারের সংকট দেখিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানোর হিসাব-নিকাশ ছিল। তৃতীয় কোনো শক্তি ক্ষমতা দখল করত বলে তাদের ধারণা ছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে দেশে লাগাতার অবরোধ, ধর্মঘট, অগ্নিসংযোগ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, গোপন স্থান থেকে সরকার উৎখাতের নিয়মিত ঘোষণা ইত্যাদি ছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনার অংশ।
২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি নেতৃবৃন্দ দেশে ‘ভোটবিপ্লবের’ মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সরকারের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিচারের সম্মুখীন করার হুমকি অনবরত দেয়া হয়। এসব হুমকি শুধু উপরের স্তরের নেতারাই দিয়েছেন তা নয়, তৃণমূল পর্যায়েও জামায়াত-বিএনপি, ২০-দলীয় এবং ঐক্যজোটের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের দেখিয়ে দেয়ার হুমকি অনবরত দিয়েছিল।
এসব হুমকিকে প্রশাসনসহ কোনো স্তরের কর্মকর্তা এবং বিবেকবান মানুষ হালকাভাবে নিতে পারেনি। কেননা, ২০০১-০৬ বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটি শুধু নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরই হত্যা নির্যাতন এবং এলাকাছাড়া করেনি, দেশের প্রশাসনেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুতি-আক্রমণ, হত্যা ও নির্যাতন করেছে। বিশেষত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা-আক্রমণ, নির্যাতন-নারী ধর্ষণ, গ্রাম ও দেশছাড়া এবং কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, বৈষম্য, পদবঞ্চিত করার ঘটনা সারা বিশ্বে সমালোচিত হয়।
বিএনপি এবং জামায়াত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে কী রূপে আবির্ভূত হতে পারে, তার স্বরূপ কেমন হতে পারে তা ২০০১-০৬ সালে তাদের শাসনকালে প্রতিদিনের ঘটনা ছিল। নৌকায় ভোট দেয়া জামায়াত-বিএনপির দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, অপরাধ। সেটি তারা সেই সময় প্রকাশ্যেই উচ্চারণ করে। নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে অনেককে হত্যা করা হয়। এমনকি চাঁদপুরে এক বাড়িতে আক্রমণ করতে গিয়ে ঘরে থাকা এক শিশু সন্তানকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা। বলা হয়েছিল এই শিশুটিও ভবিষ্যতে নৌকার ভোটার হবে।
আওয়ামী লীগের শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মমতাজউদ্দীন, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমামসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, সংঘটিত হয়েছে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড। দেশে জঙ্গিদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বেশ কজন শিক্ষক-সাংবাদিক, লেখক-বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী-বিচারক হতাহত হন। দেশের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। প্রশাসনেও অসংখ্য অসাম্প্রদায়িক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত কিংবা অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়। দেশে একটি ভয়ানক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। বিকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সর্বত্র চালু করা হয়। রাজনীতি থেকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির উচ্ছেদ করা হয় নির্বিচারে।
এখন সেই শক্তিই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য প্রতিদিন মায়াকান্না করছে! যারা ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার করছে তাদের অতীত ইতিহাস কিংবা রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের ন্যূনতম আদর্শের ঐতিহ্যের উপস্থিতি ছিল বলে প্রমাণ দেয়া কঠিন। সে কারণেই মির্জা ফখরুল ও অন্য নেতারা যখন শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের কথা বলেন, একইসঙ্গে যখন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের দেশছাড়া করা হবে, বিচার করা হবে, শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলে হুমকি দেন, তখন ২০০১-০৬ সালের দুঃসহ স্মৃতির কথাই একটু বয়স্কদের মনে পড়ে।
তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়েও যেসব অঘটন ঘটিয়েছিল তাও স্মরণ করলে বিএনপির মুখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা খুব বেশি শুনতে ভালো লাগে না। সেকারণেই বিএনপি নেতাদের ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টির আবদনে বিবেকবান মানুষদের সাড়া মিলছে না। গণতন্ত্রের জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তি হতে হয়। সেই ভরসার স্থান রাজনৈতিকভাবে বিএনপি হতে পারেনি।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।